সন্তান ধারণে অক্ষমতা, বন্ধ্যাত্ব এরকম নানা কারণে নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে। অনেক নিঃসন্তান দম্পতি আছেন যারা, বাবা–মা হবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বছরের পর বছর নানা চেষ্টাচরিত করেও ব্যর্থ হন। সন্তানের মুখে বাবা ডাক, মা ডাক শোনার জন্য উদগ্রীব থাকেন। এই মানবিক আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেকেই এখন শিশু দত্তক নিতে চাইছেন। কিন্তু ইচ্ছে ও সামর্থ্য থাকলেও আইনী জটিলতা অনেকক্ষেত্রে বাধ সাধে। কারণ বাংলাদেশে শিশু দত্তকসংক্রান্ত আইনের সুনির্দিষ্ট এমন কোনো বিধান নেই, যাতে একটি শিশু পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাছাড়াও জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ–এর যে দুটি অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি, তার একটি হচ্ছে, অনুচ্ছেদ ২১। যেখানে শিশুর দত্তকের কথা উল্লেখ আছে। অনুচ্ছেদ–২১ অনুযায়ী “শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থের কথা সর্বাধিক বিবেচনা করে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্র দত্তক পদ্ধতিকে স্বীকৃতি ও অনুমোদন দেবে। (ক) শিশুকে দত্তক গ্রহণের বিষয়টি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পাদিত হবে। প্রচলিত আইন ও নিয়ম অনুসারে এবং নির্ভরযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত কর্র্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে যে পিতামাতা, আত্নীয়স্বজন ও আইনসম্মত অভিভাবকদের সাথে শিশুর সম্পর্ক এমন যে, দত্তক অনুমোদনযোগ্য এবং প্রয়োজন হলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ প্রয়োজনীয় পরামর্শের ভিত্তিতে দত্তক প্রদানে সুচিন্তিত মত দিয়েছেন। খ) যদি নিজ দেশে কোনো পরিবারে শিশুকে দত্তক হিসাবে স্থান করে দেয়া না যায় অথবা শিশুর নিজ দেশে যদি লালন পালনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব না হয় তা হলে উক্ত শিশুর লালন পালনের জন্য আন্তঃদেশীয় দত্তকের ব্যবস্থা বিবেচনা করা যেতে পারে। গ) আন্তঃদেশীয় দত্তকের ক্ষেত্রে শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ব্যবস্থা জাতীয় দত্তক প্রথা অনুযায়ী হতে হবে এবং এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ঘ) শিশুকে দত্তক দেয়ার নামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাতে অবৈধ অর্থ আয় করতে না পারে সেজন্য সকল উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ঙ) এই অনুচ্ছেদে উল্লেখিত বিষয়গুলোকে কার্যকর করতে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক সমঝোতা বা চুক্তি সম্পন্ন করবে এবং এ কাঠামোর মধ্যে অন্য দেশে শিশুর স্থানান্তরের বিষয়টি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা দ্বারা যাতে পরিচালিত হয় সে বিষয় নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদে স্বাক্ষর না করার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ধর্মান্তরিত হবার আশংকা ও মানবপাচারকে। সেসব কারণকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে পারিবারিক আইন ইসলামিক অনুশাসনের ধারায় পরিচালিত। ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা আইনত দত্তক নিতে পারেন না। কোনো পরিত্যক্ত শিশু কোন ধর্মের তা চিহ্নিত করার উপায় থাকে না। সেহেতু জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম নিয়ে একটা আশংকাও থেকে যায়। কিন্তু আইন ২০১৩ এর অধীনে অভিভাবকত্ব লাভ করতে পারেন। এই আইন দত্তক গৃহীত সন্তানকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করার অধিকার দেয় না। তবে শিশুর অভিভাবকত্বকে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছে। যদিও গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট–১৮৯০ অনুসারে কোনও দম্পতি চাইলে শিশুর অভিভাবকত্ব অর্জন করতে পারেন। কিন্তু সেটা দত্তক নয়, অভিভাবকত্ব। আইনী প্রক্রিয়ায় অভিভাবকত্ব অর্জন করলে তাতে শিশুকে নিজ জিম্মায় রেখে লালিত পালিত করতে পারেন। কিন্তু তার মাধ্যমে পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তারপরেও মানুষ শিশুর অভিভাবকত্ব নেন। যা অহরহ দেখা যায়।
ইতোমধ্যে একজন সেলিব্রিটি অভিনেত্রীও আইনী প্রক্রিয়ায় একটি কন্যা শিশুর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছেন। তেমন আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে। এখনো অনেক ক্ষেত্রে খুব অনানুষ্ঠানিক। অনেক সময় তা ঝুঁকিপূর্ণও হতে পারে। জন্মদাতা দম্পতি যে কোনো সময় এসে নিজেদের সন্তানের দাবি করে বসতে পারেন। আর সন্তান যেতে চাইলে সে যেতে পারবে। একসময় গ্রামেগঞ্জে দেখা যেতো কোনো গরীব বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত মা যার আরও সন্তান আছে, তিনি নিজ সন্তানকে লালনপালন করতে অপারগ, কোনো সচ্ছল কিন্তু নিঃসন্তান দম্পত্তির হাতে সন্তানকে হস্তান্তর করছে। হয়তো কিছু অর্থও পেয়ে যান তাতে, স্ট্যাম্পে সই করে সন্তানের অনাপত্তিপত্র/না–দাবি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দেন। কিন্তু সেটা কোনো আইনী প্রক্রিয়া নয়।
বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতিদের একমাত্র বিকল্প হলো ১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের অধীনে বৈধ অভিভাবকত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করা। আইন অনুযায়ী শিশুর বয়স ১৮ বছরের কম হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, অভিভাবকত্বের অধীনে থাকা শিশুরা সমস্ত অধিকার ভোগ করে না, যেমন বৈধ অভিভাবকের কাছ থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায় না। এটা শিশুদের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে একরকম অনিশ্চয়তা তৈরি করে। এমনও হতে পারে, যে শিশুকে আজ ভালোবেসে অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা হয়েছে, সময়ের বিবর্তনে সে শিশুর প্রতি সমান আবেগ ও মানবিকতা কাজ নাও করতে পারে। এভাবে তারা দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। তাদের সম্পত্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো আইনি অভিভাবক যদি মৃত্যুর আগে কোনো সম্পত্তি ‘উপহার’ হিসেবে সন্তানকে দান করে যায়। আদালত সেসব বিবেচনা করে শিশুর অভিভাবকত্ব দেবার আগে অভিভাবকত্ব নিতে আগ্রহী পিতামাতার অর্থবিত্ত কিংবা সচ্ছলতার কথাও বিবেচনা করেন, যাতে শিশুটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত না হয়। সে কারণে আদালত শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার কথা মাথায় রেখে কিছু সম্পদ (অর্থ বা জমি) শিশুর নামে লিখে দিতে বলেন এবং আদালত কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি শিশুর অভিভাবকত্ব গ্রহণকারী পিতামাতা শর্ত পূরণ করছেন কি না তাও তদারকি করে আদালতের নিকট পেশ করা হয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ও ১৯৩৭ সালের মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়াহ) অনুযায়ী, এতিম বা অসহায় শিশুকে লালন–পালন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে সন্তানের পিতামাতার নামের স্থলে পালক দম্পতির নাম কখনো ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ইসলাম তার বৈধতা দেয় না। এদিকে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইন (সংশোধিত) অনুযায়ী একটি শিশুকে দত্তক নিতে পারে। তবে শুধু ছেলে শিশুকে দত্তক নেওয়া যাবে। পালক দম্পতিকে সমগোত্রের হতে হবে। আর অবশ্যই দত্তক ন্েওয়া ব্যক্তিকে হতে হবে পুরুষ। পরিবার অনুমতি দিলেই কেবল স্ত্রী কোনো শিশুকে দত্তক নিতে পারবে।
শিশুকে নিয়ে বিদেশ গমন বৈধ। অভিভাবকত্বের প্রক্রিয়া হলো প্রথমে অভিভাবকত্ব নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি জন্মদাতা কিংবা শিশু যে এতিমখানায় আছে তাদের অনুমতি সাপেক্ষে দেওয়ানী কার্যবিধি আইন অনুযায়ী পারিবারিক আদালতে একটি আবেদন করবে। আবেদনটি পর্যালোচনা করার পর আদালত যদি সন্তুষ্ট হন যে পিতামাতারা সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য, তাহলে বৈধ অভিভাবকত্বের অনুমোদন দেওয়া হবে। আর আদালত বিরুদ্ধে আইন দিলে জেলা জজ আদালতে আপীল করা যাবে।
অনুমোদন দেওয়া হলে উভয়পক্ষ আদালতে উপস্থিত হবে এবং প্রকৃত পিতামাতাকে বিচারকের সামনে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা অভিভাবকত্বের জন্য স্বেচ্ছায় সন্তানকে অন্যপক্ষের কাছে তুলে দিচ্ছে। আইনি অভিভাবকেরা শিশুটিকে দেশের বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেই মূলত সমস্যা দেখা দেয়। আন্তঃদেশীয় দত্তক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হেগ কনভেনশন অন প্রোটেকশন অফ চিলড্রেন অ্যান্ড কো–অপারেশনের সদস্য নয়।
বাংলাদেশের আইন দেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি শিশুদের সম্পূর্ণ দত্তক নেওয়ার অনুমতি দেয় না। তাই বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের (দ্বৈত নাগরিক) প্রথমে বাংলাদেশে পারিবারিক আদালত থেকে অভিভাবকত্ব পেতে হবে। তারপরে তারা যে দেশে বাস করবে সেখানে শিশুটিকে দত্তক নিতে হবে।
তবে তাতে আট ধাপের প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। বৈধ অভিভাবকত্ব নিতে, ভিসার জন্য আবেদন করতে এবং অবশেষে শিশুটিকে বিদেশে নিয়ে যেতে এক বা দুই বছর সময় লাগতে পারে।
যদি সম্ভাব্য দত্তক গ্রহণকারী পিতামাতাকে– যারা বিদেশে বসবাস করছেন – আবাসিক দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়, তাহলে তাদেরকে অভিভাবকত্ব প্রক্রিয়ার জন্য প্রত্যাশিত দত্তক গ্রহণকারী সন্তানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করতে হবে। যাতে পরবর্তীকালে অভিভাবকত্ব বা দত্তক নিয়ে কোনো আইনি সমস্যা না হয়।
তারপরে তাদের আইনি অভিভাবকত্বের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। এসব নথির মধ্যে রয়েছে শিশুর জন্মসনদ, জন্ম দেওয়া দম্পতির অনাপত্তি, আবেদনকারী দম্পতির একজন যে বাংলাদেশি নাগরিক তার প্রমাণ এবং এমন নথি যেগুলো বিদেশে বসবাসের সর্বোচ্চ সত্যতা নিশ্চিত করে।
আদালতের সিদ্ধান্তের পর, শিশুর অভিভাবকদের সন্তানের অভিভাবকত্ব–পরবর্তী জন্ম সনদ নিতে হবে। যেখানে তাদের বৈধ অভিভাবক হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ থাকবে।
আর যদি বৈধ অভিভাবক শিশুকে বিদেশ নিয়ে যেতে যান তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি অনাপত্তিপত্র অবশ্যই নিতে হবে। যাচাইবাছাই শেষেই দেওয়া হয় এই অনাপত্তিপত্র।
অন্য দেশে নিয়ে যেতে শিশুর পাসপোর্টের জন্য অনাপত্তিপত্রসহ যাবতীয় সব নথি জমা দিতে হয়। তারপর ভিসা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকাদানের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আবেদনকারীকে। এরপর সে দম্পতিকে তার বসবাস করা দেশের আইন অনুযায়ী শিশুটিকে দত্তক নিতে হয়।
ফলত, কত দম্পতিই সন্তান না থাকায় দত্তক নিতে চায়। কিংবা ভিন্ন দেশের দম্পতি বাংলাদেশ থেকে শিশু দত্তক নিতে চায়। কিন্তু জটিল আইনি প্রক্রিয়ার কারণে তারা সেটা পারে না। আদালতের শুনানির জন্য একজন মানুষ কতবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসতে পারবে?
এটা সত্য যে মানবপাচার ও অন্যান্য অপরাধের একটা ভয় থেকে যায়। তবে প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত ও জটিলতামুক্ত হওয়া উচিত।
যদি পারিবারিক আইন বা ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিগত আইন সংশোধন করা হয়, তাহলে ধর্মীয় মুসলমান বা হিন্দুরা এতে একমত হবেন না। তাই ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে একটি পৃথক ধর্মনিরপেক্ষ দত্তক আইন নিয়ে আসা ভালো হবে।
দত্তক গ্রহণের ধর্মনিরপেক্ষ আইনের অধীনে এতিম ও অভিভাবকহীন পরিত্যক্ত শিশুদের দত্তক নেওয়া যাবে। তাদের দত্তক নেওয়ার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেননা এটি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং পিতামাতা ও পরিবারের স্নেহ দেবে।
শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রাম