বছর দশেক আগেও হ্রদ-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি বেড়াতে এসে যেকোনো পর্যটক অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতেন। আর এখন সবুজ পাহাড় কিংবা স্বপ্নিল হ্রদ দেখতে আসা আগন্তুক হতাশ হন বিবর্ণ রাঙামাটি দেখে। দখলবাজরা কেড়ে নিয়েছে রাঙামাটি শহরের সেই মুগ্ধতা। কর্ণফুলী নদীতে ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ হয়। কাপ্তাই এলাকায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে বলে কালের পরিক্রমায় ৭৭৫ বর্গকিলোমিটারের কৃত্রিম হ্রদটি সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে যা কাপ্তাই হ্রদ নামে পরিচিতি পায়।
বর্তমানে এই হ্রদ শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়; মৎস্য সম্পদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। গাছ, বাঁশ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় হ্রদটি অসামান্য অবদান রাখছে। পুরো জেলার ছয়টি উপজেলার সাথে যোগাযোগ করা হয় এই হ্রদ দিয়ে। হ্রদটি রাঙামাটির ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। যে হ্রদটি পুরো জেলার অর্থনৈতিক চাকা ঘুরাচ্ছে সেই হ্রদটি সবচেয়ে গ্রাসের শিকার হচ্ছে। হ্রদের পাড়ে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সুবিশাল অট্টলিকা, হোটেল-মোটেল। এসব হোটেল-মোটেল এবং আবাসিক ভবনের বর্জ্যগুলো নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে হ্রদ।
শহরের রিজার্ভ বাজার, বনরূপা, গর্জনতলি, তবলছড়ি, পুলিশ লাইন, পুরাতন বাস স্টেশন এলাকাসহ চারপাশেই হ্রদের ওপর স্থাপনা চোখে পড়ে। হ্রদের ওপর স্থাপনা নির্মাণ ছাড়াও এসব স্থাপনার পয়ঃনিষ্কাশন লাইনও সরাসরি দেওয়া হয় হ্রদের জলে। এতে শহরবাসীর খাবার ও ব্যবহার্য পানির প্রধান উৎসটি ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিপন্ন হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের সুস্বাদু মাছ। হ্রদের পানিতে বাড়ছে বিভিন্ন ক্ষতিকারক জীবাণুর উপস্থিতি।
এই হ্রদের পানি এ অঞ্চলের মানুষ নির্দ্বিধায় পান করত। বর্তমানে গভীর নলকূপের পানিই খাবারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে এনজিও ফোরাম ফর ড্রিংকিং ওয়াটার অ্যান্ড সাপ্লাই এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী বিভাগের এক পরীক্ষায় কাপ্তাই হ্রদের পানি খাবারের জন্য অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো যখন যে ক্ষমতায় এসেছে তাদের দলের নেতাকর্মীরা কাপ্তাই হ্রদের পার দখল করে সাধারণ মানুষের সাথে বাণিজ্য করেছে। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎকোচের বিনিময়ে এসব অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে কাপ্তাই হ্রদের পরিধি ছোট হয়ে আসছে।
সম্প্রতি কাপ্তাই হ্রদ দখল করে বহুতল ভবন গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিরুদ্ধে। পার্বত্য জেলা পরিষদের অর্থায়নে শহরে তবলছড়ি ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় গড়ে উঠছে দুইটি বহুতল ভবন। তবে জেলা পরিষদ বলছে, দুইটি প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো গড়ে উঠছে নিজস্ব জায়গায়। ভবন দুটি নির্মাণে এপর্যন্ত সাত কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
রাঙামাটি নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব এম জিসান বখতেয়ার বলেন, কাপ্তাই হ্রদকে দূষণমুক্ত এবং দখলমুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।এই হ্রদ যদি ভবিষ্যতে না থাকে তাহলে পার্বত্য রাঙামাটি তার চিরচেনা রূপ হারাবে।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি নদী রক্ষা কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, কাপ্তাই হ্রদ পুরো রাঙামাটি বাসিন্দাদের জন্য খুবুই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে এই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে। যদি এইভাবে হ্রদটি দখলের জোয়ারে ছোট হতে থাকে তাহলে পুরো জেলার চিত্র বদলে যাবে। জীব-বৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের উচিত কাপ্তাই হ্রদের দিকে নজর দেওয়া। পাশাপাশি স্থানীয় সচেতন মহলের নৈতিক দায়িত্ব হ্রদ দখদারীদের বিরুদ্ধে একযোগে সোচ্চার হওয়া। তাহলে কাপ্তাই হ্রদটিকে রক্ষা করা যাবে।
রাঙামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক বলেন, কাপ্তাই হ্রদে ভবন করার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। প্রভাবশালী মহল স্থাপনা নির্মাণ করায় প্রশাসন দৃঢ়ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি পৌর মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলেন, রাঙামাটি পৌরসভা রেকর্ডিয় জায়গায় বিল্ডিং করার অনুমতি দিয়ে থাকে। তারা ভবন নির্মাণের অনুমতি নিয়েছে এবং আমি যতটুকু জানি তারা তাদের নিজস্ব জায়গায় ভবন নির্মাণ করছে।
এদিকে জেলা পরিষদের ভবন দুটি নির্মাণ প্রসঙ্গে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) বিরল বড়ুয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, জেলা পরিষদ হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই নিয়মনীতি মেনে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি বাজার ফান্ডের রেকর্ডিয় নিজস্ব জায়গায় ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তারপরেও বিষয়টি নিয়ে যেহেতু কথা উঠেছে তাই আমি সরেজমিনে গিয়ে বিস্তারিত দেখব। অপরদিকে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ কে এম মামুনুর রশীদ বলেন, কাপ্তাই হ্রদে যেসব ভবন অবৈধভাবে হচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা অনেকগুলোর কাজ বন্ধ রেখেছি এবং অনেক ভবনের কর্তৃপক্ষ তারা কোর্টে মামলা করেছে।