কক্সবাজার জেলার দুটি প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর ওপর নির্ভর করছে এখানকার প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা। অথচ বাঁকখালী এখন দখল ও দূষণের কবলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এই কথা বললেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা কঙবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। কৃষি ও পানীয় জলের নিশ্চয়তা এবং উর্বরা ভূমির কারণে পৃথিবীর আদি সভ্যতাগুলো নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠে বলে ধারণা করা হয়। আর নদীর জলধারা বা নাব্যতা পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণে নদীর গুরুত্ব ও অধিকার তুলে ধরতে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) ‘নদীর অধিকার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস।
নদীকে সারা পৃথিবীর জলচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও পৃথিবীর ধন বলা হয়। নদী পৃথিবীর জীবনরক্ত ও মানব স্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য হিসাবে বিবেচিত। নদী গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য ধারণ করে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মিষ্টি পানি সরবরাহ করে। আর নদীর কারণেই সমগ্র বাস্তুতন্ত্র সরাসরি ভারসাম্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু দখল ও দূষণের কারণে দিন দিন মরে যাচ্ছে দেশের নদ–নদীগুলো। বলা হচ্ছে, দেশের নদ–নদীগুলো এখন বার্ধক্য কবলিত।
বিশ্ব নদী দিবস হলো একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান, যা নদীর গুরুত্ব ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববারে উদযাপিত হয়, যেটি ২০০৫ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব নদী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো সারা বিশ্বের নদীগুলির পরিচ্ছন্নতা ও সংরক্ষণের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, বিশ্বজুড়ে সমস্ত জলপথগুলো আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের সুবিধার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের জন্য মানুষকে একত্রিত করা। দেশে নদ–নদীর সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১১ সালে তাদের এক প্রকাশনায় উল্লেখ করেছে, নদ–নদীর সংখ্যা ৪০৫। বাংলাপিডিয়া অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭০০টি নদী প্রবাহিত এবং সেসব নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪,১৪০ কিলোমিটার। এদেশে ৫৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী ও তিস্তাকে দেশের প্রধান নদী বলা হয়। আর এদেশের দীর্ঘতম ও বৃহত্তম নদী বলা হয় মেঘনাকে। তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে, সংখ্যাটি হবে ৯০৭। আর দীর্ঘতম নদী হবে ইছামতী।
গত ১০ আগস্ট জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের সব নদ–নদীর একটি খসড়া তালিকা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। কমিশন বলছে, তালিকায় থাকা সব নদী জীবন্ত, অর্থাৎ এসব নদী মরে যায়নি। বর্ষাকালে এসব নদীতে পানি থাকে। তবে কিছু নদী শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়।
তালিকা অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি নদ–নদী রয়েছে সিলেট বিভাগে। আর সবচেয়ে কম নদী রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় নদীর সংখ্যা ১৫৭। আর চট্টগ্রাম বিভাগের ৫ জেলায় নদীর সংখ্যা মাত্র ৬০টি। নদ–নদীর সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ। এই দুই বিভাগে নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ১৩৫ ও ১২৪। এরপর নদীর সংখ্যা বেশি রংপুর বিভাগে ১২১টি। তারপর ঢাকা বিভাগে ১১৮টি। আর রাজশাহী বিভাগে নদীর সংখ্যা ৭১টি। তবে ‘ধান–নদী–খাল এই তিনে বরিশাল’ হিসাবে পরিচিত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগে নদ–নদীর সংখ্যা কম, মাত্র ৯৯টি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকা অনুযায়ী, দেশের দীর্ঘতম নদী হল ইছামতী। এর দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিলোমিটার। আর দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদ ধনু। এই নদের দৈর্ঘ্য ৩০৩ কিলোমিটার। তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকায় পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য কত, তা উল্লেখ নেই। তবে কেউ কেউ নদীটির দৈর্ঘ্য ৩০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি হবে বলে মনে করেন।
তালিকা অনুযায়ী, দেশের ৫২টি নদী আছে, যাদের দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটারের বেশি। আর ১৫টি নদী আছে, যাদের দৈর্ঘ্য ২০০ কিলোমিটারের বেশি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ–পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, দেশে নৌপথের মোট দৈর্ঘ্য ৯৮৩৩ কিলোমিটার। আর এর মধ্যে ৫৪০০ কিলোমিটার নৌ–পথ শীত–বর্ষা সকল সময়ে ব্যবহারযোগ্য।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ইকোসিস্টেমস বা বাস্তুতন্ত্র হলো উদ্ভিদ, প্রাণী, মাটি, পানি এবং অণুজীবগুলি যেখানে একসাথে বসবাস করে এবং অস্তিত্বের জন্য একে অপরের উপর নির্ভর করে। বাস্তুতন্ত্র বন্য গাছপালা এবং প্রাণীদের বাসস্থান সরবরাহ করে, বিভিন্ন ফুড চেইন ও খাবারের ওয়েবগুলিকে ঠিক রাখে, প্রয়োজনীয় পরিবেশগত প্রক্রিয়া ও জীবন ধারণকে নিয়ন্ত্রণ করে। জৈব ও জৈব উপাদানগুলির মধ্যে পুষ্টি পুনর্ব্যবহারের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তুতন্ত্র জলচক্র, কার্বন চক্র, অঙিজেন চক্র, নাইট্রোজেন চক্র ও শক্তি চক্রসহ একই বাস্তুতন্ত্রের শক্তির যথাযথ প্রবাহ বজায় রাখে।
পৃথিবীতে কয়েক লক্ষ স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। একটি পুকুর বা কুয়াকে কেন্দ্র করেও স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠতে পারে। তবে পৃথিবীতে মূলত ৬ ধরনের বাস্তুতন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে বনভূমি, তৃণভূমি, মরুভূমি, মিঠা পানি ও সামুদ্রিক পানির জলাধার এবং আর্কটিক তুন্দ্রা অন্যতম। আর এসব বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মানুষের টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল মিঠা পানির জলাধার বা নদীর বাস্তুতন্ত্র।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ কৃষিকাজে সেচের জন্য, পানীয় জলের জন্য, মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতের জন্য নদীকে ব্যবহার করে আসছে। আর গত শতাব্দী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও নদীকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এছাড়া সাঁতার এবং নৌযান চালানোর মতো অবকাশ যাপনের জন্যও নদীর ব্যবহার হয়ে আসছে। আর নদীর এই ব্যবহারকে ঘিরে গড়ে ওঠছে বৈচিত্র্যময় সভ্যতা ও সংস্কৃতি। দেশের উচ্চ আদালত ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসাবে ঘোষণা করেছে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনছারুল করিম বলেন, বাংলাদেশ নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বিশ্বের জল ব্যবস্থাপনার সাথে মিতালী রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উঁচু অঞ্চলের জল বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে মিশে যাচ্ছে। এসব জল বিভিন্ন নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ায় এখানকার জমির উর্বরতা বেশি। যার কারণে বিশ্বে সবচেয়ে উর্বর ভূমির দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই আমাদের দেশের স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, সবোর্পরি নিজের স্বার্থে নদী রক্ষা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. আশরাফ আলী ছিদ্দিকী বলেন, পরিবেশে বা বাস্তুতন্ত্রে একটি নদী এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, এর অস্তিত্বের উপর নির্ভর করছে মানুষসহ ওই বাস্তুতন্ত্রের সকল প্রাণের অস্তিত্ব। এ কারণে উচ্চ আদালত দেশের সকল নদ–নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ বা জীবন্ত সত্তা হিসাবে ঘোষণা করেছে।