সুশাসন নিশ্চিতকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ ও দক্ষ কর্মী পাঠানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিদেশে শ্রমবাজার সমপ্রসারণ করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, এতে বর্তমানের প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স মাত্র দুয়েক বছরের মধ্যে ৩০–৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে নেয়া সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সর্বোচ্চ এই খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সম্প্রতি আজাদীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ এবং অবৈধভাবে অন্তত এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করেন। তাদের মধ্যে অদক্ষ মানুষের সংখ্যাই বেশি। যারা অত্যন্ত স্বল্প বেতনে ওখানে কাজ করেন। কিন্তু অদক্ষ জনগোষ্ঠীকে কিছু ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে পাঠানো সম্ভব হলে তাদের বেতন ভাতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতো। ভারত এবং ফিলিপাইনের একজন দক্ষ শ্রমিক যে পরিমাণ বেতন ভাতা পান, বাংলাদেশের অদক্ষ একজন শ্রমিক তার অর্ধেকও পান না। ফলে দেশের আয় কমছে। অথচ একজন দক্ষ শ্রমিক বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারলে ওই একই খরচেই বাড়তি আয় করতে পারে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশীদের জন্য ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে বিদেশের শ্রমবাজার। জাল কাগজপত্র, দুর্নীতি, মানব পাচারসহ নানা অভিযোগে গত বছর বেশকিছু দেশে শ্রম অভিবাসন বন্ধ হয়েছে। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করছেন–এমন প্রচারণা থাকলেও বাংলাদেশী কর্মীদের অভিবাসন মূলত কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর সিংহভাগ অভিবাসী উপসাগরীয়, অন্যান্য আরব, পূর্ব ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ১২–১৩টি দেশেই যাচ্ছেন। পাঁচ বছরে ৯৭ শতাংশ কর্মী গেছেন মাত্র ১০টি দেশে। গত বছরে ৯০ শতাংশ বাংলাদেশী কর্মী অভিবাসিত হয়েছেন মাত্র ছয়টি দেশে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ জন পুরুষ ও নারী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০২৩ সালে অভিবাসী পুরুষ ও নারীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩। ২০২৪ সালে সৌদি আরবেই গেছেন ৬০ শতাংশ কর্মী। এছাড়া মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ, কাতারে ৭ দশমিক ৫৬, সিঙ্গাপুরে ৫ দশমিক ৭৬, আরব আমিরাতে ৫ দশমিক ২০ ও জর্ডানে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ কর্মী গেছেন। পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অভিবাসন সংখ্যা কমেছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে রেমিট্যান্স আয় ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য আনতে নতুন দেশ অনুসন্ধান করার পাশাপাশি কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যথায় বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে, যা দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তাছাড়া অবৈধপথে মানুষের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ যে সব দেশে বাংলাদেশের শ্রমশক্তির চাহিদা বেশি, সেসব দেশে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে দ্রুত আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর করা জরুরি। তাছাড়া, আমাদের এখন নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করতে হবে এবং দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানিতে মনোযোগ দিতে হবে। তাঁরা বলছেন, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ যথেষ্ট পিছিয়ে আছে। এর একটি প্রধান কারণ দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে আমাদের পিছিয়ে থাকা। এ ক্ষেত্রে আরো উদ্যোগী হতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বৈধপথে কর্মী পাঠাতে হলে এ খাতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। বিদেশগামী শ্রমিকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করায় তাদের অভিজ্ঞতা ও আয় অনেকাংশে সীমিত থাকে। সুতরাং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে শ্রমবাজারের চাহিদার বাস্তব সংযোগ তৈরি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা ও ভোকেশনাল ট্রেনিং কেন্দ্রগুলোর পাঠ্যক্রম আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী করা উচিত। বিদেশী ভাষা, কম্পিউটার, কেয়ার গিভার, যন্ত্রচালনা বা অপারেটিং স্কিল, নির্মাণ, ড্রাইভিংয়ে দক্ষতা অর্জনে জোর দিতে হবে। দক্ষ কর্মী তৈরিতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বৈধপথে দক্ষ জনশক্তি রফতানি বাড়াতে হলে পুরো কাঠামো সংস্কার করা উচিত।








