বাংলাদেশের দক্ষিণ উত্তর সীমান্তবর্তী পার্বত্য জেলাগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের উপস্থিতি বেশ পুরানো। সমপ্রতি বান্দরবানে কুকি চিন নামে একটি সংগঠন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা দুর্গম পাহাড়ে ট্রেনিং সেন্টার চালু করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, রয়েছে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং।
মাঝে মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের গুঞ্জন শোনা যায়। অনেক সময় কোনো কোনো দেশের রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও এই কথা বলে থাকেন। প্রশ্ন হলো, এটার কি কোন সত্যতা আছে? নাকি এটা সংখ্যাগুরুদের জুজুর ভয় দেখানোর কোনো রাজনৈতিক কৌশল? বাস্তবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি নয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার বাইরে বাকি সাতটি দেশে ৫ শতাংশেরও কম।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসারের শুরু ভারতের কেরালা ও তামিলনাড়ু অঞ্চলে। যদিও কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে তক্ষশীলার কথা বলে। বর্তমানে তক্ষশীলা পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পড়েছে। তবে কেরালায় এখন প্রায় ২০ শতাংশ জনসংখ্যা খ্রিষ্টান এবং তামিলনাড়ুতে ৬ শতাংশ। আর পাকিস্তানে রয়েছে ১ শতাংশের কম।
তবে খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের গুঞ্জন এসব এলাকার জনসংখ্যার পরিসংখ্যান থেকে তৈরি হয়নি। এ গুঞ্জন তৈরি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় জনপদগুলোকে ঘিরে। এতে মিয়ানমারের সন্নিহিত অঞ্চলও যুক্ত রয়েছে। উত্তর–পূর্ব জনপদগুলোর মধ্যে মেঘালয় (৭১ শতাংশ), মিজোরাম (৮৭ শতাংশ) এবং নাগাল্যান্ডে (৮৮ শতাংশ) খ্রিষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই তিন জনপদ লাগোয়া নয়, তবে কাছাকাছি। মিয়ানমারের চিন এস্টেটও এদের কাছের জনপদ, চিন এলাকায় ৯৬ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় এই চারটি জায়গা হলো খ্রিষ্টানপ্রধান। চারটি জায়গাতেই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী রাজনীতিবিদদের রাজ্য চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। তবে জনপদগুলো আয়তনে ও লোক সংখ্যায় ছোট।
এই চারটি এলাকার পাশাপাশি মণিপুর ও অরুণাচলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক খ্রিষ্টান জনসংখ্যা (৪১ ও ৩০ শতাংশ) আছে। আর এই দুইটি অঞ্চলকে বিবেচনায় নিলে সেটি বেশ বড় একটি বলয় তৈরি করে। আয়তনে যা দুই লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি।এর পাশাপাশি ভারতের মিজোরাম ও মায়ানমারের চিন রাজ্য সংলগ্ন বাংলাদেশের বান্দরবানের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় (রুমা, থানচি, পরায়াংছড়ি) খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। এখানে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশের মতো। আর এই কারণেই বিষয়টির প্রতি বাংলাদেশের সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে।
অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন নামে কাছাকাছি থাকা একই ধর্মীয় বেশ বড় একটি এলাকার জনবিন্যাসের এ প্রবণতা নিশ্চিতভাবে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান তিন ধর্ম হিন্দু–মুসলিম–বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্টরা এটা ভালোভাবে নেন না। দক্ষিণ এশিয়ায় খ্রিষ্টান রাজ্যের গুঞ্জন কেবল এই বিশ্বাসীদের সংখ্যাগত বৃদ্ধির কারণে নয়। উল্লিখিত এলাকাগুলোর অনেক বৈশিষ্ট্যও (পাহাড়ি) এ বিষয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যেমন মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, চিন, মণিপুর, বান্দরবানের একাংশ এবং অরুণাচলের মধ্যে অনেক এলাকায় নানান দাবিতে বছরের পর বছর ধরে চলছে নিরস্ত্র–সশস্ত্র ব্যাপক আন্দোলন–সংগ্রাম। কোথাও সশস্ত্রতার ধরন ব্যাপক ও গভীর, কোথাও তা মৃদু, কিন্তু অগ্রাহ্য করার মতো নয়। এসব সশস্ত্রতার প্রধান ধরন হলো এ অঞ্চলের ‘রাষ্ট্র’গুলোর ক্ষমতাসীনদের প্রতি আস্থার সংকট। তবে এই অনাস্থার পটভূমি তৈরি করেছে উপরিউক্ত প্রতিটি এলাকার উন্নয়ন–প্রান্তিকতা ও বৈষম্যের মাধ্যমে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে এসব অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ক্রমে সংকুচিত ও সীমিত গণ্ডিতে আবিষ্কার করেছে। ফলে তাদের মধ্যে একধরনের আত্মরক্ষার বোধ বেড়েছে। এসব জনপদের মানুষ জানে তারা কোনো দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি সিদ্ধান্তকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারবে না। কারণ ৫৪৩ আসনের ভারতীয় লোকসভায় অরুণাচল–মণিপুর–মেঘালয়–মিজোরাম–নাগাল্যান্ড মিলে আসন মাত্র ৯টি। অথচ উত্তর প্রদেশের আসন ৮০টি। মিয়ানমারের পার্লামেন্টের (দুই কক্ষ মিলে) ৬৬৪ আসনে চিন এস্টেটের আসন ২১টি। বাংলাদেশে ৩০০ আসনের পার্লামেন্টে বান্দরবানের জন্য আসন ১টি। যেহেতু আসন বণ্টন হয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে, তাই এই বাস্তবতা শিগগির বদলাবেও না। ফলে এসব জনপদের মানুষ জানে, নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তাদের উপস্থিতি সীমিত।
অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসনামলের সময় ও তারও আগে এসব এলাকার জাতিসত্তাগুলো সমতলের মানুষদের থেকে দূরে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় যে রকম ট্রাইবাল স্বশাসন ভোগ করেছে, তার ঘাটতিও তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি করেছে। তার উপরে নিজেদের চারপাশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধদের সংখ্যাবৃদ্ধির মুখে তারা নিজেদের ধর্ম রক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছে। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন সময় চার্চগুলোয় আক্রমণ এবং এই ধর্মবিশ্বাসীদের ওপর হামলার ঘটনাও উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় জনপদের মানুষদের আত্মরক্ষার একটা ধর্মীয় ধরন যুক্ত করেছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় খ্রিষ্টান জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি এবং অতি প্রচার ও কথিত গুঞ্জন এর কারণ বলে মনে করা হয়। তবে এরপরও ভারতে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা ৩ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশে অনেকে বান্দরবানের খ্রিষ্টান জনসংখ্যার বৃদ্ধি নিয়ে বলেন। কিন্তু শুমারির তথ্যে দেখা যায়, সেখানে ৯–১০ শতাংশ খ্রিষ্টানের বিপরীতে মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় ৫৩ শতাংশ এবং সর্বশেষ দুটি শুমারির মধ্যে মুসলমান বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। আর খ্রিষ্টান জনসংখ্যা বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম।
তবে প্রশ্ন হলো, এত কিছুর পরেও দক্ষিণ এশিয়ার খ্রিষ্টান সমাজ বা উল্লিখিত জনপদগুলো কি কখনো ধর্মভিত্তিক নতুন কোনো রাষ্ট্রের দাবি তুলেছে? বা এর জন্য কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন আছে? বা এরকম দাবির সপক্ষে খ্রিষ্টান সমাজের বা গির্জামণ্ডলীর কোনো ইশতেহার আছে? এসব প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
তারপরও ক্রমাগত এ রকম দাবি ও গুঞ্জন উঠেছে এবং সেটা মূলত অখ্রিষ্টানদের তরফ থেকে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশে বিশেষ বিশেষ মতাদর্শের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই বিষয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের মতো আশপাশের অন্যান্য দেশের বৌদ্ধ ও ইসলামপন্থী অনেক মহলও এ প্রচারণায় উৎসাহী। বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর এরকম অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক আর কোনো বিষয়ে তেমন দেখা যায় না। আবার অনেকে খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের গুঞ্জনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কথিত ওই রাষ্ট্রের জন্য ইউরোপ–আমেরিকার আগ্রহের কথাও বলেন। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো বিশ্বাস যোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারেন না। আর এ রকম প্রচার খ্রিষ্টানদের জন্য নানাভাবে বিব্রত অবস্থা তৈরি করছে। বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারাও কয়েক মাস আগে এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, খ্রিষ্টান রাষ্ট্রের প্রচার তাদের সঙ্গে অন্যান্য সমপ্রদায়ের দূরত্ব সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করছে।
তারপরও যে এ রকম একটা প্রচারের পালে সমপ্রতি বাতাস লেগেছে, তার কারণ মণিপুর ও চিন প্রদেশের ঘটনাবলি। মাসের পর মাস ধরে চলমান মণিপুর দাঙ্গায় হিন্দু মৈইতৈইদের হাতে খ্রিষ্টান কুকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পার্শ্ববর্তী মিজোরামে তাদের প্রতি সহানুভূতির নীরব এক ঢেউ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মিয়ানমারের চিন প্রদেশের স্থানীয়দের প্রতিও মিজোরামের অনুরূপ সহানুভূতি রয়েছে। আর তার সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের কুকি চিন সংগঠনের সরব উপস্থিতি। তবে সব মিলিয়ে কোনোভাবেই যেন জটিল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে না যায়–সেই প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক: কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।