থিনারের মতো ভয়াবহ দাহ্য পদার্থ থেকে নির্গত গ্যাসই চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের ভয়াবহতম জাহাজ বিস্ফোরণের ঘটনার জন্য দায়ী। থিনারের মতো দাহ্য পদার্থ যেভাবে সিলগালা কন্টেনারে রাখার কথা ছিল সেভাবে এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের স্টোর রুমে ছিল না। এতে করে থিনারের কন্টেনার থেকে নির্গত গ্যাস ইলেক্ট্রিক স্পার্কের সংস্পর্শে আসার পরই বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতিতে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জাহাজটির সামনের অংশ দিয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাইরে বের হওয়ার ৭ সেকেন্ড পর প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। মাত্র সাড়ে ৪ মিনিট সময়ে জাহাজটিতে পরপর তিনবার বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের সময় জাহাজটিতে ওয়ার্কশপের মেইনটেনেন্স স্টাফসহ সর্বমোট ৪৩ জন মানুষ ছিলেন। এদের মধ্যে তিন হতভাগ্য মারা যায়। জাহাজটি থেকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে (ইআরএল) খালাস করা হচ্ছিল।
ভয়াবহতম এই ঘটনার তদন্তের জন্য বিপিসি, বিএসসি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করে। ইস্টার্ন রিফাইনারি গঠিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গতকাল সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ শরীফ হাসনাতের নিকট ঘটনার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত উল্লেখ করে ১৪ দফা সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনেই ঘটনার জন্য মারাত্মক রকমের দাহ্য পদার্থ থিনার থেকে নির্গত গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে মতামত দেয়া হয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারির উপ–মহাব্যবস্থাপক (আইঅ্যান্ডএস) ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম নঈম উল্লাহকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে ম্যানেজার (সেফটি) ইঞ্জিনিয়ার বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকীকে সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, ডিজিএম (পিঅ্যান্ডএস) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মোস্তাফিজার রহমান, ডিজিএম (ইন্সটলেশন) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ নাজির আহমেদ, এজিএম (জি অ্যান্ড ই) ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ শরাফত আলী, এজিএম (শিপিং) মোহাম্মদ শাহীনুর তালুকদার এবং এজিএম (ট্রেনিং/এফ অ্যান্ড এস) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।
কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ পরিদর্শন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের চিফ অফিসার মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান, পাম্প ম্যান মোহাম্মদ সেলিম, ইস্টার্ন রিফাইনারির অপারেশন্স এসিসটেন্ট মোহাম্মদ আশরাফুল মাওলা, সিকিউরিটি শিফট লিডার মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, আনসার সদস্য সাব্বির রহমান এবং ফায়ার শিফট লিডার মোহাম্মদ আবদুস সালামের সাক্ষাৎকার নেয়।
জাহাজের চিফ অফিসার মোহাম্মদ সাইদুজ্জামান তদন্ত কমিটিকে বলেন, জাহাজের হাইড্রোলিক কুলারসহ কিছু মেনটেন্যান্স কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া ছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসসি মেরিন ওয়ার্কশপ থেকে মেনটেন্যান্সের লোকজন জাহাজে এসেছিল। মেনটেন্যান্স কাজের জন্য স্টোররুমে প্রবেশের মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে।’ জাহাজের পাম্পম্যান মোহাম্মদ সেলিম তদন্ত কমিটিকে বলেন, ফোর পিক স্টোরে রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস, পেইন্ট, থিনার ইত্যাদি রাখা হয়। মেনটেন্যান্স কাজ করার জন্য তিনজন স্টোররুমে প্রবেশ করার মুহূর্তে বিস্ফোরণ হয়।
মোহাম্মদ আশরাফুল মাওলা বলেন যে, সকাল ১০টা থেকে কার্গো খালাস কার্যক্রম শুরু করা হয়। বেলা ১১ টার একটু পূর্বে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনে রুম থেকে বের হয়ে আসেন এবং দেখতে পান জাহাজের সম্মুখভাগে আগুন জ্বলছে। তিনি দ্রুত গেট ভাল্ব বন্ধ করে লোডিং আর্ম ডিস্কানেক্ট করার ব্যবস্থা করেন। মোহাম্মদ আবদুল হান্নান বলেন যে, তিনি প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়ে জেটির গেইট পোস্ট থেকে বের হয়ে আসেন এবং জাহাজের সম্মুখদিকে কালো ধোঁয়া ও আগুন দেখে সিকিউরিটি (ম্যানেজার) কে জানান। তদন্ত কমিটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে কেউ কোন সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।
ঘটনা প্রসঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করা মাদার ভ্যাসেল ‘ওমেরা লিগ্যাসি’ থেকে ক্রুড অয়েল নিয়ে ইআরএলের ডলফিন জেটি–৭ এ সোমবার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মুরিং শুরু করে এমটি বাংলার জ্যোতি। জাহাজটিতে ক্রু এবং মেইটেনেন্স ওয়ার্কারসহ ৪৩ জন ছিলেন। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে ইআরএলের তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার মেসার্স ওশানটেক লিমিটেড জাহাজটি সার্ভে করে। সার্ভে অনুযায়ী জাহাজটিতে ১১ হাজার ৭১৬ দশমিক ৪৪৬ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল ছিল। সকাল ১০টায় ক্রুড খালাস শুরু হয়।
সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনার বরাত দিয়ে তদন্ত কমিটি রিপোর্টে উল্লেখ করে যে, সকাল ১০টা ৫২ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে দুজন ক্রু জাহাজের সম্মুখভাগের ফোর পিক স্টোরের ওপরের অংশে প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে ১০টা ৫৩ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে আরও এক ব্যক্তি ওই স্থানে পৌঁছায়। কমিটির সদস্যরা ধারণা করেছেন যে, উক্ত তিনজনই ফোর পিক স্টোরে প্রবেশ করেন। ১০টা ৫৪ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে জাহাজের ওই স্টোরের ওপর কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে থাকে এবং ৭ সেকেন্ড পর স্টোরের ওই অংশে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় স্টোর কম্পার্টমেন্ট থেকে বিভিন্ন অংশ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কালো ধোঁয়াসহ আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ১০টা ৫৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ হয়। ১০টা ৫৮ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে তৃতীয় বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকে।
এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের কার্গো খালাস শুরু হয় সকাল ১০টা থেকে। সকাল ১০টা থেকে ১০টা ২০মিনিট পর্যন্ত ২০ মিনিট সময়ের মধ্যে বিএসসি মেরিন ওয়ার্কশপের কয়েকজন কর্মী রক্ষণাবেক্ষণ কাজের উদ্দেশ্যে জাহাজটিতে ওঠেন। জাহাজটির সামনের দিকের ফোর পিক স্টোর যেখানে রশি, নোঙর, খুচরো যন্ত্রাংশ, পেইন্ট, থিনার ইত্যাদি রাখা ছিল সেটি মুলতঃ একটি কনফাইন্ড স্পেস (আবদ্ধ জায়গা)। ওখানে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ছিল না। এতে করে ওই স্টোরে রাখা থিনার থেকে নির্গত প্রচুর পরিমানে দাহ্য গ্যাস জমা হয়ে বিস্ফোরকের উপকরণ তৈরি করতে পারে। যা হিট সোর্সের (মেকানিক্যাল বা ইলেক্ট্রিক স্পার্ক) উপস্থিতিতে বিস্ফোরিত হয়েছে বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিস্ফোরণের ফলে জাহাজটির সম্মুখভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং তিনজনের প্রাণহানী ঘটেছে।
‘ফায়ার ট্রায়াঙ্গেল থিওরি’ উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি মতামত দিয়েছে যে, আগুন লাগার জন্য তিনটি উপাদান (ফুয়েল, অঙিজেন এবং ইননিশন সোর্স) অপরিহার্য। স্টোরে থাকা থিনার থেকে নির্গত বাষ্প উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক। থিনার কন্টেনার যথাযথ সিলড না থাকলে থিনার থেকে পরিবর্তনশীল গ্যাস বাষ্পীভূত হয়ে উচ্চ দাহ্য পদার্থে রূপ নেয়। বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তের ধোঁয়া এবং বিস্ফোরণ পরবর্তী অগ্নিকাণ্ডের ধরন বিবেচনায় শর্টসার্কিট কিংবা ইলেক্ট্রিক্যাল স্পার্কের সঙ্গে দাহ্য গ্যাসের সংস্পর্শে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে বলেও কমিটির সদস্যরা মন্তব্য করেছেন।