মো. হাসান হালিশহর গরীবে নেওয়াজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর পারিবারিক টানাপোড়েনে গ্যারেজে কাজ শুরু করেন। ছোট্ট বয়সে ২০০৮ সালে এক দুর্ঘটনায় হাসান তার বাবাকে হারান। তখন ছোট বোনের বয়স সাত মাস। মা পেশায় গার্মেন্টসকর্মী। একা সংসার সামলে ছোট মেয়ে ও হাসানকে পড়াশোনা করিয়েছেন হাসানের মা। গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক দেওয়া কর্মসূচিতে চট্টগ্রামে যোগ দেয় হাসান ও তার বন্ধু শহিদুল ইসলাম সৈকত। এ সময় চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাসে আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ তখন টিয়ারশেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় শিক্ষার্থীদের। টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় যখন পুরোটা অন্ধকার তখন গুলি এসে লাগে হাসানের মাথায়। গুলি এক পাশে লেগে অপর পাশে বেরিয়ে যায়। তখন তার বন্ধু তাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়। এরপর থেকেই হাসান আইসিইউতে ছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে নিয়ে গেলে প্রায় ১০ মাস পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মো. হাসানের মৃত্যু হয়।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে তার মৃত্যু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এক ফেসবুক পোস্টে হাসানের মৃত্যুর বিষয়টি জানান। ‘এম্পাওয়ারিং আওয়ার ফাইটারস’ নামে একটি ফেসবুক পেজে হাসানের বোনের বরাতেও একই কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম আহত যোদ্ধা আমাদের ভাই হাসান থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটু আগে শহীদ হয়েছেন। সবাই দোয়া করবেন। খবরটি নিশ্চিত করেছেন ফোন করে হাসানের ছোট বোন সুমাইয়া।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ২১ মিনিটে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে উল্লেখ করা হয়, গত সাত মাস ধরে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে ছিলেন মোহাম্মদ হাসান। গত ১০ এপ্রিল হাসানকে লাইফসাপোর্ট থেকে সরিয়ে সাধারণ বেডে আনা হয়। ২৫ এপ্রিল তার অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে পুনরায় লাইফসাপোর্টে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট টাইগারপাসে আন্দোলনের সময় হাসানের মাথার ডান পাশে গুলিবিদ্ধ হয়, এতে তার ব্রেন ড্যামেজ হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার খাদ্যনালী ও কণ্ঠনালী এক করে লাইফসাপোর্ট দেওয়া হয়। এ সময় ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ে তার মস্তিষ্কে, এবং শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে দ্রুত তাকে ঢাকা সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হাসানের মা মাহেনুর বেগম। তিনি জানান, ১৬ বছর আগে স্বামীকে হারিয়ে যে কষ্ট পেয়েছি, সেটা তিন সন্তানকে দিয়ে লাঘব করার চেষ্টা করেছি। এখন আবার সেই কষ্ট। ছেলেটাকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছি। এক বছর আগে ছোট্ট একটা কাজে যোগ দিয়েছে। আমি এতদিন চাকরি করেছি, মেয়েরা বড় হয়েছে। ভাবছি এবার অবসর নেব। এখন এই অবস্থায় আমি দিশেহারা।
হাসানের বন্ধু শহিদুল ইসলাম সৈকত আজাদীকে বলেন, হাসানের মরদেহ রোববার আনা হতে পারে। তার মা কাল চলে আসবে হয়ত। হাসানকে আনার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী নেওয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, হাসান চট্টগ্রামে আইসিইউতে থাকার শুরু থেকেই আমি তার সাথে ছিলাম। ডাক্তার বলেছেন গুলি লেগে হাসানের মাথা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কিছু মগজও বেরিয়ে গেছে। পরে দেশে আর চিকিৎসা না হওয়ায় তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।