ঈদুল আজহা মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম। বাংলাদেশে এটি কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদ ও আজহা দুটিই আরবী শব্দ। ঈদের অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আজহার অর্থ কোরবানি বা উৎসর্গ করা। হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অতুলনীয় আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর নির্দেশের প্রতি অবিচল আনুগত্যের ঘটনাটি বিশ্বসাহিত্যের উপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, তুরস্কের ন্যায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের সাহিত্যই নয়, ইউরোপের অমুসলিম সাহিত্যেও এর সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গ্রিসেও কবি হোমারকে এ অসাধারণ আত্মত্যাগের ঘটনা প্রভাবান্বিত করেছে। মহাকাব্য ইলিয়াডে এর উদাহরণ রয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও ঈদুল আজহার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর রচনা কোরবানি। তিনি কোরবানি কবিতায় লিখেছেন -‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন/দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহে খাম্খা ক্ষুদ্ধ মন/ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর/আজিকার এ খুন কোরবানির! দুম্বা–শির রুম–বাসীর/শহীদের শির–সেরা আজি! রহমান কি রুদ্র নন/ব্যস! চুপ খামোশ রোদন!….আজ আল্লাহর নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন/ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন।’ শুধু পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি সম্ভব নয়। এটা নজরুলের মনগড়া কথা নয়। আল্লাহপাক বলছেন– তোমাদের জবাই করা পশুর রক্ত–মাংসের আল্লাহ ফিরেও তাকান না, তিনি দেখেন তোমাদের মনের তাকওয়া। কোরবানির শিক্ষা হলো মনের পশুকে জবেহ করে নিজেকে খোদায়ী রঙে সাজিয়ে তোলা। সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা ও অধর্মের বিরুদ্ধে সাহসের সাথে গর্জে ওঠা। ঈদুল আজহা আত্মত্যাগে ডুবে যাওয়ার দিন। ঈদুল আজহায় অন্ধকার দূর করে দেয়। রাতের আঁধার ভেঙে নতুন সকাল নিয়ে আসে। নজরুল বলেছেন, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো বিদ্বেষমুক্ত প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলা। যতদিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত ন্যায়–ইনসাফ–সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবে না। নজরুলের শহীদি ঈদ নামক কবিতায় বলেছেন -‘শহীদের ঈদ এসেছে আজ/শিরোপরি খুন–লোহিত তাজ/চাহি না ক’ গাভী দুম্বা উট/কতটুকু দান? ও দান ঝুট/চাই কোরবানি, চাই না দান/রাখিতে ইজ্জত ইসলামের/শির চাই তোর, তোর ছেলের/দেবে কি? কে আছ মুসলমান?’
নজরুল বলেছেন, মুসলমানের দায়িত্ব হলো বিদ্বেষমুক্ত প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলা। যত দিন পর্যন্ত মুসলমান জাতি আত্মপূজা এবং স্বার্থপরতা ত্যাগ করতে না পারবে, তত দিন পর্যন্ত ন্যায়–ইনসাফ–সাম্যের পৃথিবী গড়ে উঠবে না। স্বার্থপরের জন্য জান্নাত হারাম। নজরুলের সাফকথা -‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে/মুসলিম নহে ভণ্ড সে/ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/দাও কোরবানি জান ও মাল/বেহেশত তোমার কর হালাল/স্বার্থপরের বেহেশত নেই।’
‘তোমরা ইসলামকে কবর দিয়ে আবার নিজেদের মুসলিম বলে গর্ব করছ! আরে, তোমাদের মতো পোশাকি ধার্মিক, লোকদেখানো কোরবানিদাতারাই তো ইসলামের গলায় ছুরি বসিয়ে ইসলাম নামের শান্তি ও মুক্তির নৌকাটিকে ডুবিয়ে ফেলেছ।’ তারপর তিনি বলেছেন, ‘নামাজ–রোজার শুধু ভড়ং,/ইয়া উয়া পরে সেজেছ সং/ত্যাগ নাই তোর এক ছিদাম/কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কর জড়/ত্যাগের বেলাতে জড়সড়/তোর নামাজের কি আছে দাম?’
চট্টগ্রামে প্রচলিত কিছু কথিত ‘আচার’ কোরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে ম্লান করে দেয়। এখানে কিছু মানুষের মাঝে আছে প্রতিযোগিতার মনোবৃত্তি। কার চেয়ে কে বড় গরু কিনবে সেই প্রতিযোগিতা চলে। আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অন্তত প্রথম বছর গরু/ছাগল দেয়া যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অনেকে ধার–দেনা করে ছাগল হলেও দিয়ে থাকে, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য। কোরবানি হয়ে গেছে যৌতুকের অংশ। এসব কবে বন্ধ হবে কে জানে। এটা কোরবানির শিক্ষা নয়। কোরবানির শিক্ষা হচ্ছে ত্যাগ।
কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেয়ার মনোভাব গড়ে উঠতে হবে। নয়তো এটি নামমাত্র ভোগবাদী উৎসবই থেকে যাবে। কোরবানি কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কোরবানিতে যদি সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে, তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছু হবে না। ঈদুল আজহা আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত হয়। ঈদুল আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার ও রিপুর তাড়না থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকেই কোরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানির মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব অনিশ্চয়তা–শঙ্কা দূর হোক। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে একসঙ্গে এক কাতারে পবিত্র ঈদুল আজহার আনন্দে শামিল হয়ে সবার মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জাগিয়ে তুলাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আনন্দ ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে ঈদের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।