এটি সর্বজনবিদিত যে, অবাধ মুক্ত বিশ্বাস ও যথার্থ জীবন–দর্শন উম্মোচন করে হাজার বছরের সংস্কার এবং ধর্মান্ধতার বৃত্ত ভেঙ্গে পবিত্র কোরআন মানব জগতকে করেছে অপরিমেয় আলোকবর্তিকায় উদ্ভাসিত। জাগতিক–পরজাগতিক সকল চিরায়ত সত্যকে প্রকাশ করে মহান প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে মানবিক গুণে ঋদ্ধ হওয়ার অমিয় বারতা সমৃদ্ধ পবিত্র কোরআন প্রত্যেক ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মত পার্থক্যের অবসানে সফল ভূমিকা পালন করে আসছে। অজ্ঞতাকে মহাপাপ হিসেবে অভিহিত করে সমগ্র মানব সমাজকে জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির পথে ধাবিত হওয়ার অসাধারণ অনুপ্রেরণা এই মহাগ্রন্থ। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শব্দের ‘কোর’ অর্থ পড়া আর ‘আন’ অর্থ সর্বক্ষণ অতএব এর আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘সর্বক্ষণ পাঠকর’। বিশ্বজনীন আশংসিত সত্য যে; পবিত্র ইসলাম ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ হচ্ছে কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত। এই অবশ্য পালনীয় রোকনসমূহের মধ্যে রোজা পালন এবং হজ্ব আদায়ের সাথে সম্পর্কিত ঈদ–উল ফিতর ও ঈদ–উল আযহা। পবিত্র ইসলাম ধর্মে প্রকৃত বিশ্বাসী ধার্মিক নাগরিক সারা বছর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সকল ইহকালীন লোভ–লালসাকে সম্বরণ করে নীতি–নৈতিকতার ভিত্তিতে সৎ–পূত পবিত্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাঁদের উদ্দেশ্যে উপহারস্বরূপ মহান স্রষ্টা আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদ–উল–ফিতর এবং ঈদ–উল–আযহা উদযাপন প্রবর্তন করেন।
পুরো একটি মাস মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রতিফলনের উপহার স্বরূপ ঈদ–উল ফিতর এক অপূর্ব উৎসব। এই উৎসবসমূহ ধনী–দরিদ্র, রাজা–প্রজা, শোষক–শোষিত প্রত্যেকের জন্যই অনাবিল সম্প্রীতি–সৌহার্দের বহি:প্রকাশ ঘটিয়ে মানবিকতার মহাত্মকে অত্যুজ্জ্বল করে। সকল শ্রেণি পেশা নির্বিশেষে প্রত্যেকেই যার যার সামর্থ অনুযায়ী নতুন পোষাক–পরিচ্ছদ, খাবার–দাবার এবং নামাজ শেষে প্রীতি–বিনিময়ের অনুষঙ্গে ঈদ হয়ে উঠে সর্বজনীন। আবার এই ঈদকে ঘিরেই সারাটা বছর বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগকৃত ব্যবসায়ীবৃন্দ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নানা ধরণের আকর্ষনীয় কাপড়–চোপড় ও সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি বিক্রির মহাউৎসবে মেতে ওঠে। পুরো বছরের সকল আয়োজন সম্পন্ন হয় রোজার মাস ও ঈদ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। একই ধারায় ঈদ–উল আযহা বা মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ্ করে সবাইকে নিয়ে আনন্দ সহকারে ভোজন–বিতরণ উৎসব অত্যন্ত উপভোগ্য। অমর অক্ষয় সত্যাগ্রহ শক্তির মহিমায় মানবজাতির হৃদয়ে লালিত পশুশক্তির নিধন এবং ত্যাগের প্রেরণা উম্মোচনের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে ঈদ–উল–আযহার তাৎপর্য।
ঈদ–উল–আযহা বা কুরবানীর ঈদ প্রত্যয়টি পবিত্র কুরআনে ‘কুরবানী’র পরিবর্তে ‘কুরবান’ হিসেবে ব্যবহৃত। পবিত্র হাদিসেও ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর বিপরীতে ‘উযহিয়াহ’ ও ‘যাহিয়া’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে ‘ঈদ–উল–আযহা’ যার আরবী প্রতিশব্দ ‘কুরবান’। মূলত: আরবী শব্দ ‘কুরবাতুন’ বা ‘কুরবান’ থেকে কুরবানী শব্দের উৎপত্তি। এই কুরবানীর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ত্যাগ। পবিত্র ইসলামের চতুর্থ রোকন পবিত্র হজ্ব পালনের অংশ হিসেবে জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পরম ত্যাগের আদর্শ স্থাপন এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে নিজের মনের সকল আকুতি নিবেদন করেন। উক্ত কারণেই প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কুরবানীর ঈদ পালন করেছেন এবং সামর্থ্যবান কুরবান বর্জনকারীদের সম্পর্কে সতর্কবার্তা নির্দেশিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাঁহে না আসে’। কুরবানীর স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন‘। (সূরা আল হজ্জ–৩৪)
রাসূল (সা🙂 আরও বলেছেন, ‘কুরবানীর দিনে আল্লাহর উদ্দেশ্যে রক্ত প্রবাহিত (কুরবানী করা) অপেক্ষা প্রিয়তর কোন কাজ নেই। অবশ্যই কিয়ামতের দিন (কুরবানীদাতার পাল্লায়) কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও তার ক্ষুরসহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা প্রফুল্ল মনে কুরবানী করো’ (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)। নির্দিষ্ট বয়সী গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা ছাড়া অন্য কোন পশু দিয়ে কুরবানী ইসলামে অনুমোদন নেই। দৈহিক ত্রুটিযুক্ত পশু যেমন–কানা, খোড়া, কানকাটা, লেজ কাটা, শিং ভাঙ্গা ও পাগল পশু দ্বারা কুরবানী করা নিষিদ্ধ। (শামী, ৫ম খন্ড) মহানবী (সাঃ) প্রিয় কন্যাকে কুরবানী সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে ফাতিমা! আপন কুরবানীর নিকট যাও। কুরবানীর প্রথম রক্ত বিন্দুতে তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ হবে এবং জন্তুটি কিয়ামতের দিন সমুদয় রক্ত, মাংস ও শিং নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তোমার আমলের পাল্লা ৭০ গুণ ভারী হবে।’ (ইসবাহানি)
ঈদ–উল আযহা বা মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ্ করে সবাইকে নিয়ে আনন্দ সহকারে ভোজন–বিতরণ উৎসব অত্যন্ত উপভোগ্য। মুসলমানদেরকে কুরবানীর মাংস খাওয়া এবং অন্যকে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে আদেশ দিয়ে বলেন, ‘অত:পর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দু:স্থ–অভাবগ্রস্থকে আহার করাও’ (আল কুরআন–২২:২৮)। নবীজী (সাঃ)ও কুরবানির মাংস খেতে উৎসাহ দিতেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘কিছু খাও, কিছু সঞ্চয় কর এবং কিছু গরীবদের মাঝে বন্টন করে দাও’ (নাসাঈ)। কুরবানীর সারবত্তা হচ্ছে; অর্থ বিত্তের বিনিময়ে নিছক পশু জবেহ নয়, অন্তরের প্রগাঢ় অন্ধকার ও হিংস্র পশুত্বের নির্মূল করা না গেলে উপযাচিত এসব কর্ম কখনোই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থিত হবে না – নি:সন্দেহে তা বলা যায়।
মুসলিম জীবনে অসীম গুরুত্ব–তাৎপর্যময় উৎসব ঈদ–উল–আযহা। উৎসবটির সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি। ঈদ শুধু বিলাসিতা বা আনন্দ উপভোগের নাম নয়। এতে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ–সহমর্মিতা–ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপম বৈশিষ্ট্য। সম্প্রীতি–সৌহার্দ–বন্ধুত্বের চিত্ত–বৈজয়িক উপযোজনে সার্থক হয়ে ওঠে ঈদের এ আনন্দ উৎসব। বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রধান অনুষঙ্গ নানা মাত্রিকতায় সমাজ বিবর্তনের সাম্প্রতিক কালে এই উৎসব শুধু ধার্মিকতায় নয়, ধর্ম–দল–মত নির্বিশেষে এক অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বিকশিত। ঈদ উৎসব বা পূজা পার্বনে ধর্ম–বর্ণ, জাত–পাত, ধনী–গরীব নির্বিশেষে মানুষকে মানুষের মর্যাদায় আসীন করার মধ্যেই প্রকৃত ধর্মের বাণী উচ্চারিত। বাঙালির ঈদ উৎসব বা সকলকে নিয়ে আনন্দের ভাগাভাগিতে মেতে ওঠা, নাচ, গান, নাটক, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, আনন্দ ভ্রমন ইত্যাদির সমন্বয়ে এটিকে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামোতে না রেখে ধর্ম নিরেপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উপস্থাপিত হলেই এর মর্যাদা এবং তাৎপর্য অনেক বেশি মহিমান্বিত হবে – সেটিই স্বাভাবিক। এভাবেই মানব সমাজের বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুশাসন এবং অনুশীলন সামাজিক সম্পর্কের গঠন ও অভিজ্ঞতাকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আরোপিত হয়ে এটি সম্প্রীতির বৈশ্বিক রূপায়নে অনুভবনীয় মহিমায় পরিপূর্ণ হবে – এ প্রত্যাশায় স্বল্প পরিসরে নিবন্ধের ইতি টানছি এবং বিশ্বের সকল মানব সন্তানের প্রতি পবিত্র ঈদ–উল–আযহার শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী