ঈদুল আজহা মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এটি কেবল একটি আনন্দ–উৎসব নয়, বরং এক মহান ত্যাগ, আত্মোৎসর্গ এবং বিশ্বাসের অনন্য উদাহরণ। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, সেই অসাধারণ ঘটনা আমাদের শেখায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ দিতেও প্রস্তুত থাকতে হবে। এই আত্মনিবেদনের অনুপ্রেরণায় আজো বিশ্বের মুসলমানেরা ঈদুল আজহা পালন করেন কোরবানির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপন একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। লাখ লাখ পশু কোরবানি হয়, যার মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পালনের পাশাপাশি এক বিশাল জনসমষ্টির খাদ্য চাহিদাও পূরণ হয়। গরু, ছাগল, মহিষ, উট প্রভৃতি পশু কোরবানি করা হয়, আর সেই পশুর মাংস আত্মীয়–স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এই উৎসব ধনী–গরিবের মাঝে সহানুভূতির সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।
ঈদুল আজহার মূল উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সম্পদের মোহ, ভোগ–বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মহব্বত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করাই হলো ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা। ইবরাহীম (আ.) এর আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তরণ ছিল নিজের তাওহীদ ও তাকওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আল্লাহর হুকুমে তিনি পুত্র কোরবানি করেছিলেন। মূলত তিনি এর দ্বারা আল্লাহর প্রতি নিজেকে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। প্রতি বছর জিলহজ মাসে মুসলিম জাতি পশু কোরবানির মাধ্যমে ইবরাহীম (আ.)-এর স্মৃতি স্মরণ করে এবং পশু কোরবানির মধ্যদিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে। ইসমাইল নবীন বয়সেই বিশ্ববাসীকে আত্মসমর্পণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা যেমন অতুলনীয়, তেমনি চির অনুকরণীয়। পশু কুরবানীর সাথে সাথে দৃঢ় শপথ নিতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমাদের জান, মালসহ যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। আর এটিই হলো কোরবানির শিক্ষা। ইবরাহীম (আ.) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছিলেন, হয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ ঘোষিত মানবজাতির ইমাম। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’।
তবে, ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য কেবল পশু কোরবানিতে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃত কোরবানি হলো নিজের ভেতরের অহংকার, হিংসা, লোভ ও আত্মকেন্দ্রিকতাকে ত্যাগ করা। ঈদুল আজহা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হলে শুধু বাহ্যিক কর্ম যথেষ্ট নয়, বরং অন্তরের বিশুদ্ধতা ও সত্যিকার ত্যাগের মনোভাবই মুখ্য। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহর নিকট পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে।” (সূরা হজ: ৩৭)
এই ঈদে কোরবানির পশু কেনাবেচা, পরিবহন ও জবাইয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
পশু কোরবানীর সাথে সাথে আমাদের যে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে তা হচ্ছে জবাইকৃত পশুর বর্জ্য অপসারণ। প্রায় সবখানে দেখা যায়, জবাই করার পর যত্রতত্র ময়লা–আবর্জনা জমে যায়। জবাইয়ের পর সাথে সাথে জায়গাটি পরিষ্কার করে ফেলা উচিত। করোনা মহামারির অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করা চলবে না। শহরাঞ্চলে কোরবানির পর বর্জ্য অপসারণে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, যাতে দুর্গন্ধ, রোগবালাই ও জনদুর্ভোগ না ঘটে। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ, নগরবাসী এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে একটি পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া কোরবানির পশু পরিবহনে অমানবিক আচরণ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং চাঁদাবাজির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড রোধে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি দরকার। ঈদের এই আনন্দ যাতে কারো জন্য দুর্ভোগে পরিণত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এই পবিত্র দিনে আমাদের উচিত সমাজের দরিদ্র, অনাথ ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। প্রকৃত ঈদ সেই ব্যক্তি ও জাতির জন্য যারা আত্মত্যাগের শিক্ষা বাস্তব জীবনে ধারণ করে, অন্যের কল্যাণে এগিয়ে আসে।
ঈদুল আজহার এই দিনে আমরা কামনা করি ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে গড়ে উঠুক এক সহনশীল, মানবিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। সকল অন্ধকার, হিংসা ও বিভেদ ভুলে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হোক। ঈদের আনন্দ হোক সর্বজনীন।
সকল পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও জাতির প্রতি রইল ঈদের শুভেচ্ছা– ঈদ মোবারক!