দুঃসংবাদের একটি হচ্ছে, গার্মেন্টসে অর্ডার কমে গেছে গড়ে এক চতুর্থাংশ। গত ২৩ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক মন্দায় দেশের তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। অর্ডার কমে গেছে গড়ে এক চতুর্থাংশ। আগামী সেপ্টেম্বরের পরে অর্ডার আরো কমে যাওয়ারও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, দেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ ওসব দেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা লেগেছে পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশে। করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে উঠার আগে নতুন এই সংকট দুনিয়াব্যাপী ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে। বিশ্বের নানা দেশে বহু কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছে, বহু কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়েছে। অনেকগুলো কোম্পানি লোকবল ছাঁটাই করে কোনোরকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক সংকটে হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। সবকিছু মিলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আগে মানুষ যেখানে দুইটি শার্ট বা দুইটি প্যান্ট কিনতেন এখন সেখানে একটি দিয়ে সারিয়ে নিচ্ছেন। ফলে ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় সুপার মলগুলোতে কাপড়ের দোকানগুলোতে ক্রেতা কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের গার্মেন্টস খাতে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস খাতের অবস্থা একটু বেশিই নাজুক।
এ কথা আজ অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অপরিসীম। এটি সময়ের দাবি। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু সারা দেশে যেখানে পোশাক শিল্প ভূয়সী প্রশংসা কুড়াচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রামে তার চিত্র বিপরীত। চরম অবকাঠামো সমস্যা ও ঋণ সংকটে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে রফতানি মুখী তৈরি পোশাক শিল্পখাত। নতুন পোশাক কারখানা স্থাপনের পরিবর্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভাড়া বাড়িতে ও বাণিজ্যিক ভবনে যৌথভাবে গড়ে ওঠা অনেক পোশাক কারখানা।
আজাদীর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত অংশীদারিত্ব ছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু নানামুখী সংকটে চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্পের সেই সুদিন আর নেই। নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতায় কমতে কমতে বর্তমানে চট্টগ্রামে গার্মেন্টস কারখানার সংখ্যা নেমে এসেছে তিনশ’রও নিচে। শ্রমিকের সংখ্যা নেমে আসে ৮ লাখের মতো। দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশীদারত্ব সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক সংকট চট্টগ্রামের কারখানাগুলো নতুন করে সংকটে পড়েছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কারখানাগুলো আবারো ধুঁকতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের বাজার সমপ্রসারণ প্রচেষ্টায় সরকারের উৎসাহ প্রদান প্রক্রিয়া আরো কার্যকর করার উদ্যোগ নিতে হবে। মিশনগুলোকে অধিকতর বাণিজ্যবান্ধব করে তুলতে হবে। তবেই তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজার সমপ্রসারণের যে নবদুয়ার উন্মোচিত হয়েছে তা আরো বিস্তৃত ও প্রশস্ত করা সম্ভব হবে। শ্রমঘন এ খাতটির প্রসার টেকসই করার জন্য অগ্রপশ্চাৎ সংযোগ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণসহ একটি জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে, তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাই চট্টগ্রামে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুতের সরবরাহসহ গার্মেন্টস কারখানাগুলোকে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া জরুরি।