২০১৮ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ২০১৫-১৬ সেশনের তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। ১৬ মাস পর ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর শুরু হয় তৃতীয় চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরের বছর ৭ জানুয়ারি তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হয়। এর এক মাস পর মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তারও এক মাস পর ৩ মার্চ শুরু হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। ২২ মার্চ ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১৫ মার্চ পরীক্ষা হওয়ার পর করোনার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। আটকে যায় দুটি ব্যবহারিক পরীক্ষা। এভাবে ২৭ মাস একই বর্ষে কেটে যায় এ সেশনের শিক্ষার্থীদের। অথচ তাদের এখন মাস্টার্স চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। এদিকে করোনার মধ্যে চতুর্থ বর্ষে অনলাইন ক্লাস চালু করার আবেদন করলেও শিক্ষকদের ‘সদিচ্ছা’র অভাবে ক্লাস শুরু হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এ সেশনের দ্বিতীয় বর্ষের ফল প্রকাশ করার পর ‘ত্রুটি’ দেখা দেওয়ায় মার্কশিট ফেরত নেওয়া হয়। এরপর ‘সংশোধিত’ চূড়ান্ত ফল এখনো দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী মো. সুমন আজাদীকে বলেন, দ্বিতীয় বর্ষের ফলাফলে আমাদের একটি ৫০ নম্বরের কোর্সে ৩৫ নম্বর ধরে ফলাফল দেওয়া হয়। ফলাফল প্রকাশ হলে সকলের প্রত্যাশিত নম্বর না পাওয়ায় কথা ওঠে। এরপর এ নিয়ে স্যারদের অভিযোগ করলে তাঁরা যাচাই-বাছাই করে দেখেন, এ কোর্সে ৩৫ নম্বর ধরেই ফলাফল দেওয়া হয়েছে। এ কোর্সে ৩৫ নম্বর ছিল তত্ত্বীয়, ১৫ নম্বর মৌখিক ও ব্যবহারিক। এরপর পুনরায় ফল দেবে বলে মার্কশিট ফেরত নেওয়া হয়। কিন্তু আজও সেই ফলাফল পাইনি।
এদিকে, ৩০৭ নম্বর কোর্সের ক্লাস ছাড়া এবং ৩০৬ নম্বর কোর্সের দুইটা ক্লাসের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রাণিবিদ্যা বিভাগে এখন অনার্সে রয়েছে ছয়টি ব্যাচ। মাস্টার্সে আছে দুটি ব্যাচ। সব ব্যাচের বেহাল চিত্র। ২০১৪-১৫ সেশনের চতুর্থ বর্ষের তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হলেও মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা না হওয়ায় অনার্সেই ঝুলে আছেন তারা। মাস্টার্সে অনলাইন ক্লাসও হচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ সেশনের এক শিক্ষার্থী আজাদীকে বলেন, ছয় বছর কেটে যাচ্ছে, এখনো অনার্স শেষ করতে পারিনি। এর জন্য কোথাও চাকরির আবেদনও করতে পারছি না। পরিবারকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না, আমরা জটে আটকে গেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পাপ করেছি। এ অনিশ্চিত জীবন আর কত!
তিনি বলেন, স্যারদের মাস্টার্সে অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে বলার পর উনারা বলছেন তোমাদের অনার্স শেষ হয়নি মাস্টার্সে কিভাবে ক্লাস করবে? আবার কোনো কোনো স্যার বলছেন, তোমরা আবেদন করো। কিন্তু আবেদন করেও কোনো ফল নেই।
২০১২-১৩ সেশনের মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল এখনো পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। ২০১৩-১৪ সেশনের মাস্টার্সে ক্লাস মাত্র শুরু হয়েছে। এখন অনলাইনেও ক্লাস হচ্ছে না। ২০১৬-১৭ সেশনের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা এখনো শুরু হয়নি। ২০১৭-১৮ সেশনের দ্বিতীয় বর্ষে তিনটি পরীক্ষা হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায় ক্যাম্পাস। করোনার মধ্যে তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু করার ব্যাপারে বিভাগে আবেদন করেও ইতিবাচক সাড়া পাননি বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৮-১৯ সেশন প্রথম বর্ষের তত্ত্বীয় পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলো আটকে আছে। অনলাইনে দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাসও হচ্ছে না। ২০১৯-২০ সেশনের মার্চে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। কয়েকদিন যেতেই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল।
এ অনুষদের অন্য আটটি বিভাগের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চার বছরেই অনার্স শেষ করে বের হয়ে যাচ্ছেন সেসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু এ বিভাগের এ হাল কেন? এমন প্রশ্নে চবি জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য প্রফেসর ড. মো. কামরুল হোসাইন আজাদীকে বলেন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিষয়টা বিভাগীয় সভাপতি ভালো জানেন। অনুষদের এটা নিয়ে কোনো কাজ নেই। আর পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ভালো বলতে পারবেন। তিনি বলেন, আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় কোনো বিভাগেরই পরীক্ষা হচ্ছে না।
অসমাপ্ত পরীক্ষাগুলো নেওয়ার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করেছেন ২০১৫-১৬ সেশনের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধন শেষে উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবরে প্রক্টরের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।
করোনার কারণে স্থগিত পরীক্ষাগুলোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক চৌধুরী আমীর মোহাম্মদ মুছা বলেন, পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন বিভাগ থেকে নির্দেশনা চাচ্ছে। এটা নিয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের সাথে শীঘ্রই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এতে অনার্স, মাস্টার্স, যাদের ভাইভা বা দু’একটি পরীক্ষা এবং ব্যবহারিক আটকে গেছে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এরপর আস্তে আস্তে ফলাফল প্রকাশ করা হবে।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. শওকত আরা বেগম আজাদীকে বলেন, স্থগিত পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে আমরা ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সাথেও দেখা করেছি। উনারা বলেছেন দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। অনলাইন ক্লাস না চলার বিষয়ে তিনি বলেন, এক বর্ষের পরীক্ষা শেষ না হলে পরের বর্ষে ক্লাস করানো নিয়মের বাইরে। এরকম অন্য কোনো বিভাগ করছে কিনা আমার জানা নেই।