পর্ব-৩
আজ আরেকটা জিনিস খেয়াল করলাম। আগের দিন তাঁবুর বাইরে গেলে ট্রেকিং বুট কিংবা সামনের দিকে পা ঢাকা ক্রকস (এক ধরনের জুতা) পায়ে গলিয়ে নিলেই হচ্ছিল। আজ গোড়ালি ছাড়িয়ে তুষারের পরিমাণ হাঁটু আর গোড়ালির মাঝামাঝি অবস্থান করায় ট্রেকিং বুটে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। এই অবস্থা আর একদিন চললে প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দিতেই স্নো বুট পরে বেরোতে হবে। মিনিট খানেকের প্রয়োজনের জন্য স্নো বুট পরা এবং খোলা এই উচ্চতায় প্রাণান্তকর কাজ। ব্যাপারটা বাকিদের জানাতেই জিতু ঘোষণা দিল, ও পানি পানের ঝামেলাতেই যেতে চায় না! ওর মাথায় হালকা চাটি মেরে অ্যাকিউট মাউন্টেন সিকনেস (এক ধরনের উচচতাজনিত অসুস্থতা) নিয়ে ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। কে যেন বলেছিল, বক্তৃতা জিনিসটা আড্ডার সবচেয়ে বড় দুশমন। সেই দুশমনের সাথে দুশমনি করে আমরা খানিকক্ষণের মধ্যেই আবার আড্ডায় ফিরলাম।
আজ দুই নম্বর ক্যাম্পে যাওয়ার কথা। সেটা যেহেতু হচ্ছে না তাঁবুতে বসে উনো খেলা আর আড্ডার গুলতানি ছাড়া উপায় নেই। বেস ক্যাম্পে এরকম অলস সময় পেয়েছিলাম দিন দুয়েকের মতো। রোদে শরীর এলিয়ে দিয়ে আর আশেপাশে হেঁটে সে সময়টা কাটাতে কোন অসুবিধেই হয়নি। এখানে সে-সুযোগ নেই বিধায় আড্ডা আর উনোই ভরসা। উনো খেলায় জিতুর দুই পাশে বসা দুইজনের ভারি অসুবিধে। সে নিজের কার্ডগুলো দেখার পাশাপাশি বাকি দুইজনের কার্ডও তার পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখে বলে বার কয়েক অভিযোগ উঠল। প্রথমে সে জোর গলায় অস্বীকার করলেও খানিক বাদে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলল। মনির ভাই কোন একটা চালে তার কাছে কার্ড নাই ঘোষণা করার পর জিতু পাশ থেকে বলে উঠল, ‘ইয়েলোর রিভার্স কার্ডটা তো আছে। সেটাই তো দিতে পারো!’ মনির ভাই নিজের কার্ডে চোখ বুলিয়ে কার্ডটা খেলতে গিয়েই আবার থেমে গেলেন। দুমদুম জিতুর পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে তবেই শান্তি। জিতু অবশ্য এরপর থেকে মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলার ব্যাপারে যথেষ্ট সাবধানী হয়ে গেল। তবে পাশের দুইজনের কার্ডেও উপর থেকে তার তীক্ষ্ম নজর হটাল না। অন্যদিকে, উনো খেলাটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে তানভীর ভাই খুব ভেবেচিন্তে চাল দেয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তানভীর ভাই আসলে চাল দেন না, দেন পোলাও! জিনিসটা একবার বাকিদেরকে বলার পর থেকে তানভীর ভাইয়ের টার্ন আসলেই বাকিরা সমস্বরে বলে ওঠে, ‘ভাই, আপনার পোলাও!’
দিনের বাকি সময়টায় সানডে সাসপেন্সে সত্যজিৎ, শরদিন্দু, প্রেমেন্দ্র মিত্রদের নানান গল্প শুনতে শুনতে কখনো হারিয়ে যাচ্ছি কলকাতায়, কখনো দার্জিলিংয়ে। সন্ধ্যায় লাকপাদের তাঁবুতে গিয়ে আরেক দফা আলোচনা করে এলাম পরদিনের যাত্রার ব্যাপারে। লাকপা নাকি দুপুরে স্নো বুট গলিয়ে আশেপাশে খানিকটা হেঁটে এসেছে। স্নো ডিপোজিশন দেখে বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেছে ও। ওর ধারণা, এই আবহাওয়া কাল-পরশুতেও ভালো হবে না। ওর কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই কিনা তুষারপাত আরো খানিকটা বাড়ল। পুরোদিন তাঁবুতে বসা-আধশোয়া থাকতে থাকতে সকলের শরীরই আড়ষ্ট। এই আড়ষ্টতা ভাঙতে কোথাও যে একটু নড়াচড়া করব সে উপায় নেই। বিকেলে এক দফা মনির ভাই, জিতু আর আমি তুষার গাইতি (আইস এক্স) ও শোভেল (শাবল) নিয়ে তাঁবুর গা-লাগোয়া তুষারের যে ঢিবিগুলো তৈরি হয়েছিল, সেগুলো পরিষ্কার করলাম। অবিরাম তুষারপাতের কবলে বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর জো অবশ্য নেই।
রাত আটটায় নিয়মমাফিক বেস ক্যাম্পে থাকা বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হলো ওয়াকিটকিতে। আমরা উপরের ক্যাম্পে রওনা দেওয়ার সময় দৈনন্দিন যোগাযোগের জন্য এই সময়টা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম। আমাদের এখানকার খবরাখবর জানিয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করলাম। রান্নাবান্নার ব্যাপারটা খুঁটিয়েই জিজ্ঞেস করলাম ওকে। এর পেছনে অবশ্য মজার একটা কারণ আছে। বেস ক্যাম্পের বড় তাঁবুটার বারান্দা মতো অংশে রাঁধতে বসেছিল ও একদিন। রান্নাও আর কী! পপকর্ণ ভাজবে প্রেসার কুকারে! আমাদের মধ্যেই কে যেন একটা পরামর্শ দিতেই ও থামিয়ে দিল ওকে। এই সুকঠিন পপকর্ণ রান্নার পুরো কৃতিত্বটা নিজেই নিতে চায়। কারো উপদেশ তাই কাম্য নয়। আমরাও ওই তাঁবুর ভেতর এটা-সেটা নিয়ে নানান গালগল্প জুড়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ। প্রেসার কুকারের ঢাকনা উল্টে তাঁবুর উপরের অংশে বাড়ি খেয়ে আবার নিচে নেমে এলো। আর এই ফাঁকে পপকর্ণ হতে প্রতীক্ষমান সকল ভুট্টার কণা তাঁবুজুড়ে ছড়িয়ে গেল। খুব সম্ভবত স্টোভটা ঠিকমতো পাম্প না করার কারণে কিংবা কুকারের ঢাকনা ঠিকমতো না লাগানোর কারণে ঘটে ব্যাপারটা। সেই জন্যই ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রান্নার বিষয় জিজ্ঞেস করা।
হিমালয়ের রাতগুলো বড্ড লম্বা। দীর্ঘ বিকাল আর রাতের মাঝখানে সন্ধ্যা নামক জিনিসটা আসে কয়েক পলকের জন্য। করার মতো কিছু থাকে না বলে তাড়াতাড়িই সেঁধিয়ে পড়ি স্লিপিং ব্যাগে। এখানে রাত নামলেই আমার বারে বারে মনে হয়, এই পৃথিবীতে আমরা বাদে আর কেউ জেগে নেই। সেই রাতেও ঘুম ভেঙেছে যথারীতি শেষ রাতে। দাড়িতে হাত যেতেই আমার লম্বা শ্মশ্রুতে কী জানি ঠেকল! স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে থেকেই বেশ কিছুক্ষণ কসরত করার পর বের করে আনতে পারলাম জিনিসটা। মাথার পাশেই রাখা হেডল্যাম্পের আলোয় দেখলাম গত কদিনের আগের সেই বিস্ফোরণে দাড়ির ভেতর সেঁধিয়ে থাকা একটা ভুট্টার দানা! শেষ রাতে খিদেটাও হালকা চাগিয়ে উঠেছিল। শরীরের তাপে পানি উষ্ণ রাখার জন্য স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে রাখা পানির বোতলে চুমুক দিয়ে ট্যাবলেটের মতো করে খেয়ে ফেললাম জিনিসটা! বাঙালি হিসেবে পাতেরটা খেয়েছি, তলারটা কুড়িয়েছি আগেই। এবার দাড়িরটাও খেলাম! চক্র পূর্ণ হলো! খাওয়ার আগে মনে মনে জপছিলাম, Everything is fair in love, war and mountains!’