তুলা আমদানিতে এক দেশ নির্ভরতা নয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো হোক

| বৃহস্পতিবার , ২২ অক্টোবর, ২০২০ at ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ

দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদা ৭৩-৭৪ লাখ বেল। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার বেল। ফলে চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থাকা ৭১ লাখ বেল আমদানি করতে হচ্ছে। তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা ভারতের ওপরই সবচেয়ে বেশি। আমদানি করা তুলার ১৯ শতাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ ভারতীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি এ খবর প্রকাশিত হয়।
পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক খাত। জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ অনেকাংশে এখাতের ওপর নির্ভরশীল। তৈরি পোশাক খাতের ক্রমবিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সুতা ও সুতা তৈরির কাঁচামাল তুলার চাহিদা। গত এক দশকেই দেশে তুলার চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি পণ্যটির উৎপাদন। এ কারণে অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা তুলা দিয়ে পূরণ করতে হচ্ছে। চাহিদার পাশাপাশি গত এক দশকে দেশে তুলা আমদানিও বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আমদানিকৃত এ তুলার বেশির ভাগ আসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সবচেয়ে বেশি তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মোট কৃষিজমি দিয়ে মূলত খাদ্যশস্য চাষ করে থাকে। পাট ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থকরী ফসল উৎপাদন হয় না। তুলাচাষ করতে বেশ লম্বা সময়ের প্রয়োজন। তুলা ওঠা পর্যন্ত ছয় মাসের মতো অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ওই সময়ে কৃষকরা দুটি শস্য তুলে ফেলতে পারেন। সেক্ষেত্রে তুলাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে সবজি ও কলার সঙ্গে। কিন্তু এত বেশি মানুষের খাদ্যের যোগান যে দেশে করতে হয় সেখানে সেটি কঠিন। এক্ষেত্রে তুলার উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে কৃষকের কাজে অধিক লাভজনক করে তোলা গেলে সুফল মিলতে পারে। বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানির চেয়েও বড় সমস্যা এর জমি। মাঝে মধ্যেই ভারত তুলা রফতানি বন্ধ করে দেয় বা উচ্চ শুল্কারোপ করে। এতে বাংলাদেশের সুতা কাপড় তৈরি কারকদের প্রতিষ্ঠানসহ তৈরি পোশাক শিল্প বিপদে পড়ে। এক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, জমি লিজ নিয়ে তুলা আবাদের সুযোগ। বাংলাদেশ থেকে কিছু উদ্যোক্তা একাজে আগ্রহী বলে জানা গেছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের অনুমোদন গ্রহণের অপেক্ষায়। তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সম্ভাবনা অনেক বলে দাবি করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আগামী কয়েক দশকে আমাদের পণ্যের চাহিদা বাড়বে। আর এর যোগান নিশ্চিত করতে হলে তুলার সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখাটা জরুরি। তুলার ওপর একক দেশ নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বিকল্প উৎস দেশ খুঁজে বের করা এবং আফ্রিকার মতো অঞ্চলে জমি লিজ নিয়ে তুলা উৎপাদন করে তা নিয়ে আসার পরিকল্পনারও বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছিল দেশের বস্ত্র শিল্প। চীন বিশ্বের বৃহত্তম তুলা উৎপাদনকারী দেশ। তবে বিশ্বে তুলার উৎপাদন কমে গেলে এ দেশটি আবার হয়ে পড়ে তুলার সবচেয়ে বড় আমদানিকারক চীন আমদানি শুরু করলে তুলার বিশ্বভান্ডারে টান পড়ে। দাম বেড়ে যায় পোশাকের । তখন বিপাকে পড়ে বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর দেশগুলো। ভারত ও চীন বিশ্বের প্রথম ও দ্বিতীয় তুলা উৎপাদনকারী দেশ। আর বাংলাদেশের তুলার চাহিদার ৯৮ শতাংশই মেটাতে হয় আমদানি করে। ফলে বিশ্ববাজারে হেরফের হলে পুরো বস্ত্র ও পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিপন্ন হয়ে পড়ে স্পিনিং তাঁতসহ অন্যান্য সহযোগী শিল্প। আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে নানা আর্থিক ও রাজস্ব সুবিধার ওপর ভর করে গত তিন দশকে তৈরি পোশাক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও স্থানীয়ভাবে তুলা উৎপাদনের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার সরবরাহ ও দামের অস্থিরতার ঢেউ এসে লাগে এদেশের তাঁত বস্ত্র ও পোশাক খাতে। সরকারিভাবে একটি তুলা উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে। তবে তুলা চাষের প্রসারে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা সীমিত। সরকারি ও সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হলেও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তামাক চাষ বাড়াচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলো। দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত হয়েও বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত এ ধরনের কোন উদ্যোগ কখনও নেয়নি। তুলা উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মতে দেশে তুলার যে বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে, স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে তা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব নয়। তবে চাষীদের কেবল উন্নত বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেও তুলার চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশেই উৎপাদন সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা যেমন বাঁচবে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারেও অস্থিরতা থেকে কিছুটা হলেও বাঁচবে। মুক্ত থাকতে পারবে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত।
তুলার উৎপাদন বাড়াতে উচ্চ ফলনশীল ও প্রতিকূলতা সহনশীল জাতের উন্নয়ন, আঁশের গুণগত মানের উন্নতিসাধন এবং জলবায়ুু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খায়, এমন লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর তুলার জার্মাপ্লাজম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, উচ্চ ফলনশীল, খরা লবণাক্ততা সহনশীল এবং মানসম্পন্ন , আঁশ উৎপাদনকারী জাতের উন্নয়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং জলবায়ু পরিবর্তনশীল এলাকায় তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য জলবায়ু অভিযোজনশীল তুলার জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে