আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনটি পক্ষের উন্মাতাল তৎপরতা চলছে– দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিভিন্ন পর্বে মিলিয়ে ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা বিএনপি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিদেশী হলেও এদেশে শেষোক্ত পক্ষ একটি ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে বার বার উড়ে আসছে বাংলাদেশে এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সমস্ত সীমা লংঘন করে এ দেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, আইন ও তথ্য মন্ত্রক এমনকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বৈঠক করছে। এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এবং অনেকটা জবাবদিহির কায়দায় চাইছে নানা তথ্য উপাত্ত। প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রায় সর্বাংশের বিদেশীদের এসব অনৈতিক কাজে সোৎসাহ বা নীরব সমর্থন লক্ষনীয়। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতা বহির্ভূত দুই বৃহৎ দল, কথিত সুশীল সমাজ কেউ সরাসরি তাদের এখতিয়ার নিয়ে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। দুই বৃহৎ দল ঐসব বিদেশীদের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন বোধগম্য কারণেই। বিদেশীরা কোন দলের পক্ষে কি বলেছেন, তাদের প্রত্যেকটি অনুকূল বা প্রতিকূলে উচ্চারিত শব্দবন্ধ নিয়ে আলোচনা শুধু দুই দলের নেতাদের মধ্যে নয় বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকের নিজস্ব প্রতিবেদকের নামে views Item এ এসবের নির্লজ্জ বিশ্লেষণ চলছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রবাসী এক অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পালের এ মর্মে ‘মূল্যবান’ মতামত দেখলাম একটি জাতীয় দৈনিকে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতির সঠিক পথে না চলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তিক্ত করে মহাভুল করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক কূটনীতির কাছে দেশের ইতিহাস তুচ্ছ ও ব্যাকডেটেড হয়ে গেল তাঁর কাছে একটি মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, এক কোটি মানুষের উদ্বাস্তু জীবনের অবর্ণনীয় কষ্ট, তিন লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রম হানি করে এবং এতে মার্কিন ভূমিকা এ সব কিছুই বর্তমানের বাস্তবতার রূঢ় প্রেক্ষিতে নাকি অর্থহীন আলোচনা। তাহলে তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করাও তো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাতেও বাধা এসেছিল ’৭১ এ এদের দোসর হিসাবে। আমাদের দেশে মানবাধিকারের জন্য মার্কিন কর্মকর্তারা যখন হাহাকার করছেন তখনি ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনিরা গৃহহীন হচ্ছে, মারা যাচ্ছে আবাল বৃদ্ধ বনিতা, সিরিয়ায় মার্কিন সৈন্য সরকারী স্থাপনায় হামলা করছে অনবরত। পুতিন পাশে না দাঁড়ালে সিরিয়ায় রাষ্ট্রপতি আসাদকে সাদ্দাম ও গাদ্দাফীর ভাগ্য বরণ করতে হত বহু আগেই। সম্ভবত সিরিয়ায় মার্কিন আগ্রাসন ঠেকানোর দায় ইউক্রেনে শোধ করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। সাদ্দাম ও গাদ্দাফির মত দুই জন রাষ্ট্র প্রধানকে খুন করে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান এই চারটি দেশকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হলো। এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুসভ্য ইউরোপ ও জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা তো দিল না। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীতে যত অশান্তি, দেশে দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, আঞ্চলিক যুদ্ধ, হত্যা, ক্যু সংঘটিত হয়েছে সর্বত্রই গণতন্ত্রের নামে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে হয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশসহ সে সব দেশে জেঁকে বসেছে তাদের অনুগত অগণতান্ত্রিক স্বৈারাচার, অর্থনীতিতে চলেছে অবাধ লুটপাট। ইন্দোনেশিয়া থেকে চিলি, ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশ হয়ে ইরাক আফগানিস্তান সর্বত্রই একই চিত্রনাট্যের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশনা। এটা তো স্বীকৃত সত্য যে, ১৯৪৭ সাল থেকে সেনা বাহিনীকে ব্যবহার করে পাকিস্তানে আমেরিকা কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি যার পরিণতি হল ’৭১ এবং সেই লিগেসী থেকে স্বাধীন হয়েও আমরা এখনো মুক্ত হইনি। সে ধারাবাহিকতায় সেকুলার ডেমোক্রেটিক কালচার আমেরিকার জন্যই এদেশের রাজনীতিতে গড়ে উঠেনি। নিজেদের কৃতকর্মের ইতিহাস জেনে শুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিকর, দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী অভব্য আচরণ ও বক্তব্যকে ক্ষমতা প্রত্যাশী বিএনপি ও কিছু পত্র পত্রিকা নির্লজ্জভাবে সাধুবাদ জানাচ্ছে আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজ স্বার্থ বিরোধী বলে বাইরে এর বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে কিছু বললেও কার্যত অনুগত দলের মতো জ্বি–হুজুর মার্কা বক্তব্য দিচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এদেশে জিয়ার সামরিক শাসনের সুযোগে এক লুটেরা কথিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি চাপিয়ে দিয়েছে। রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষার মতো রাষ্ট্রীয় বিষয় পণ্যে পরিণত হয়ে সামগ্রিক সামাজিক–রাজনৈতিক অবক্ষয় গভীর করেছে। রক্তে লেখা সংবধিানের মূলনীতি বাদ দেয়া হয়েছে, আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক খুদা কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করেছে, ’৭১ এর আস্ত খুনিদের রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়েছে রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করে দেয়ার জন্য এবং এসব কাজ অবৈধভাবে করা হয়েছে সামরিক শাসনের অধীনে রাজনীতি বিহীন পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত সরাসরি ও বেনামে চলা সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি যুক্তরাষ্ট্র করেনি বরং দেদার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএম এফের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, রাজনীতিতে চলছে অব্যাহত জবরদস্তি। নির্বাচন ক্রমে গুরুত্ব হারিয়ে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা ক্রমে বিস্তার লাভ করে সমাজকে বিভক্ত করেছে। এই ধারা নির্বাচিত সরকারগুলোর আমলে ক্ষমতার সমীকরণে আরো তীব্র হয়েছে। আজ ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের নামে মুখর বিএনপির জবাব দেয়া নৈতিক দায়িত্ব যে মাগুরা উপনির্বাচন, ’৯৬ এর ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০০১ সালে নির্বাচনোত্তর সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম নির্যাতন করে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে পুরো বিরোধী দলীয় নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অপচেষ্টা ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নানাভাবে বিতর্কিত ও অকার্যকর করে দেয়া এবংবিধ কাজগুলো কোন গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা করেছিল? রাজনীতিতে যে অনৈতিক অপরাধ সেদিন তারা করেছে তার দায় এড়িয়ে কিভাবে মানুষের কাছে তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবী করে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সিন্ডিকেট বাজী ও লুটেরা মুক্ত বাজার কি তারা বন্ধ করবে? অভিজ্ঞতা হলো করবে না। অন্যদিকে বর্তমান সরকারের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা, চরম লুটেরা অর্থনৈতিক কার্যক্রম, সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতি, সিন্ডিকেটবাজী, সাম্প্রদায়িকতাকে ভিন্ন মোড়কে লালন, ধর্মান্ধ শক্তিকে আশ্রয় প্রদান, নির্বাচনকে পুরো অর্থহীন করে তোলার জন্য আওয়ামীলীগকে আজ জবাব দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং জিয়া, এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শুধু আওয়ামী লীগ একা করেনি। বাম গণতান্ত্রিক শক্তি তখন মাঠে ছিল। তারাও জীবন দিয়েছে। এদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি প্রগতিশীল বিকল্প শক্তির বিকাশ ১৯৭৩ সাল থেকে তারা হতে দেয় নি। সর্বশক্তি দিয়ে বাধা দিয়েছে। এজন্যই আজ মাঠে বিকল্প শক্তি হিসেবে বিএনপি’র আবির্ভাব। তবে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার খাতিরে বলতে হয় যে এদেশের বিগত ৫২ বছরের ইতিহাসে একমাত্র ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাংবিধানিকভাবে শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে এর পূর্বাপর সময়ে কখনো নয়। অথচ পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসাবে বিএনপি তার মর্যাদা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ২১ আগস্ট এ দেশের রাজনীতিতে প্রতিশোধ ও ভয়ের সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনকে এই পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ও মুুক্তিযুদ্ধের চেতনা সরাসরি অস্বীকার করে, ’৭৫ এর আত্মস্বীকৃত খুনিদের পুনর্বাসিত করে, যে দলের জন্ম ও বিকাশ সেই বিএনপি’র সাথে শুধু আওয়ামী লীগ নয় মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী কোন দলের নৈতিক সমঝোতা হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথ মূল্যায়ন করে একটি রেডিকেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হিসাবে বিএনপির বিকাশ অবশ্যই অনেকের কাম্য। কিন্তু তা তো হবার নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির এই মৌলিক বিভক্তি আজ সবচেয়ে বড় সংকট যা বিদেশীদের কাছে গৌণ। মনে রাখতে হবে জামাত মুসলিম লীগ সমর্থিত ’৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশের ভোট ও সমর্থন সর্বাবস্থায় বিএনপি’র পুঁজি। এজন্য ভোটের সংখ্যানুপাতে তারা নিজেদের শক্তিশালীভাবে। এ সত্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বুঝে কিন্তু বিএনপি’র সমর্থক বলয়কে চেতনাগতভাবে জয় করার কঠিন, দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের বদলে তারা ক্ষমতার সমীকরণে রাজনীতি ও অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও ধর্মান্ধতার অন্ধ কানাগলিতে ঢুকে গেছে বিশেষ করে ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে। তারই অনুষঙ্গ হিসাবে গত ১৫ বছরে তাদের আমলে অর্থনীতি ও রাজনীতি লুটেরা কিছু কর্পোরেট হাউসের কব্জায় চলে গেছে।
ব্যাংকিং খাতের অবাধ লুটপাট, সিন্ডিকেটের কাছে পুরো বাজার ব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে নিকৃষ্ট ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের চরম পরকাষ্ঠা দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫ সালে এই প্রক্রিয়া এদেশে শুরুই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ও চাপে। তাজউদ্দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অর্থনীতি ও শিক্ষার ধারা চালু রাখা যেত, সামাজিকভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার রোধে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতির পূর্ণজাগরণ ঘটানো যেত মুক্তিযুদ্ধের মতো কষ্ট করে হলেও আমেরিকাকে বর্জন করা যেত। তাহলে বিরুপাক্ষ পাল দের নিছক চাকরির জন্য আর অভিবাসীদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে আমেরিকা যেতে হত না। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তো এদেশে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি ছিল না। বস্তুত মার্কিন মদদেই দেশে গণতন্ত্রহীনতা লুটপাট ও সাম্প্রদায়িকতার প্রবলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই দুই বৃহৎ দলের লজ্জাস্কর ব্যর্থতায় বাংলাদেশকে সার্বিক অর্থে পরনির্ভর করে রাখা, সাম্প্রদায়িক বিভেদ জিইয়ে রাখা সহ দেশটাকে পেছনে টেনে রাখার জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে হঠাৎ গণতন্ত্রের ও মানবাধিকারের সবক দেয়া, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের এদেশে ভাইসরয়ের মত আচরণ ও ব্লিনকেনের হুমকি শুনে আর এদেশে একাত্তরের গণহত্যায় তাঁর অগ্রজ কুখ্যাত কিসিঞ্জারের ভূমিকা স্মরণ করে বাঙালির শেষ ভরসাস্থল রবীন্দ্রনাথের সেই উপহাস মনে পড়ে ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ/আমি আজ চোর বটে’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।