গতানুগতিক নাটকে আর মন ভরছিল না রবিউল আলমের। কামরুল ইসলাম খোকা একদিন নাট্য পরিচালক আলী আনোয়ার মোল্লার সাথে রবিউল আলমের পরিচয় করিয়ে দেন। আলী আনোয়ার বললেন, মজা পেতে হলে নিজেরাই একটা দল করতে হবে। শুরু হল আলোচনা। আলী আনোয়ার নিয়ে এলেন দূর সম্পর্কের ভাগ্নী খালেদা ফেরদৌসকে। রবিউল আলম আনলেন প্রকৌশলী কামাল উদ্দিনকে। এই পাঁচ জনের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয় খোকার দামপাড়ার বাসায়। সাত দিনের মাথায় ১৬ মে, ১৯৭৪ সালের বৈঠকে আলী আনোয়ার দলের নাম দিলেন, ‘তির্যক নাট্যগোষ্ঠী’, আর রবিউল আলম লিখে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘জননীর মৃত্যু চাই’ নাটকের পাণ্ডুলিপি। পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হল আলী আনোয়ারকে। ‘জননীর মৃত্যু চাই’ এর প্রথম মঞ্চায়ন হল সিএন্ডবি মঞ্চে, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সাল। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল তির্যক নাট্যগোষ্ঠী।
শুরুতে চারুকলা কলেজের পুরনো বাড়ির একটা ঘরে বেশির ভাগ মহড়া করতো তির্যক। সেখানকার ফুলকি মঞ্চে ‘আকাঙ্ক্ষিত একজন’ নাটকের প্রথম মঞ্চায়নও হয়েছিল। আজ পর্যন্ত তির্যক নাট্য গোষ্ঠী ৩৪ টি নাটকের সহস্রাধিক মঞ্চায়ন করেছে। নাট্যকার সৃষ্টির অঙ্গীকারে তির্যক প্রযোজিত নাটকের অধিকাংশই (৩৪টি নাটকের মধ্যে ১৫ টি) দলের নিজস্ব নাট্যকার- রবিউল আলম, আলী আনোয়ার মোল্লা, আবু নাসের ফেরদৌস, রফিউল কাদের রুবেলের মৌলিক, অনুদিত ও গল্পের নাট্যরূপ। দলীয় নাট্যকার ছাড়াও দেশ বিদেশের নন্দিত নাট্যকারের নাটককে প্রাধান্য দিয়েছে তির্যক।
সত্তর দশকে তির্যকের তথা চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটারের প্রথম পঁচিশতম প্রদর্শনী সম্পন্ন করা মঞ্চ নাটক ‘সমাপ্তি অন্যরকম’। ১৯৮২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে এ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান করে তির্যক। ১৯৭৭ সালের ৫-১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম শিল্প ও সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত উৎসবে তির্যক পরিবেশন করে দু’টি নাটক ‘জননীর মৃত্যু চাই’ ও ‘সিসিফাসের একদিন’।
তির্যক ১৯৭৯ সালের ২২ জুন প্রথম ঢাকায় বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউজ মঞ্চে দুটি নাটক ‘জননীর মৃত্যু চাই’ ও ‘এক যে ছিল দুই হুজুর’ পরিবেশন করে। তির্যকের আলোচিত নাটকের মধ্যে ‘আততায়ী’ অন্যতম। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্তৃক সরাসরি মঞ্চনাটক সমপ্রচার অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিন ১৯৮৪ সালের ১৩ জুলাই এই নাটকটি সমপ্রচারিত হয়। ১৯৯৭ সালে আবার নতুন করে মঞ্চ নাটক সমপ্রচারের অনুষ্ঠান শুরু হলে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম নাট্যদল হিসাবে তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর রবিউল আলম রচিত এবং খালেদ হেলাল নির্দেশিত নাটক ‘বিপক্ষে বন্দুক’ প্রচারিত হয় ২৪ অক্টোবর ১৯৯৭ সালে।
তির্যক প্রযোজিত নাটকের মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে- ‘সমাধান’, ‘ভোমা’, ‘সহজ সরল পথ’, ‘অ্যাজ ইউ লাইক ইট’, ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘তীর্থযাত্রা’, ‘সত্তান্ধ’, ‘স্বপ্নবৎ’ তির্যকের অন্যতম প্রযোজনা। বর্তমানে সমমাময়িক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রফিউল কাদের রুবেলের লেখা ‘বান্দরের খেলা’ পথ নাটকের নির্মাণ কাজ চলছে।
তির্যক ১৯৯১ সালে প্রযোজনা করে মুক্ত নাটক ‘সোয়াত জাহাজ’ ৭১। ২০০৭ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মাণ করে পথনাটক ‘লজ্জা’, মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দৃশ্যকাব্য ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’। ২০১২ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্য উৎসব’ এ তির্যক ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’ প্রযোজনাটি পরিবেশন করে প্রশংসিত হয়।
১৯৭৭ সালে ‘তির্যক লিটল থিয়েটার’ নামে চট্টগ্রামে প্রথম শিশু নাট্য কার্যক্রম শুরু করে। খালেদা ফেরদৌসের নির্দেশনায় ও আবু নাসের ফেরদৌসের রচনায় দলটি তিনটি কিশোর নাটক-কাঠের ঘোড়া, আলীবাবা এবং শাহাজাদীর ঘুম ভাঙল না-এর এগারটি সফল মঞ্চায়ন করে।
চট্টগ্রামের নাট্য চর্চাকে আরো বেগবান করতে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে নাট্য উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। নাট্যকর্মী ও দর্শকদের কাছে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন সময় তির্যক আয়োজিত নাট্য উৎসবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য নাট্যদলকে। তির্যক নাট্য বিভিন্ন সময়ে নাট্য কর্মশালা, সেমিনার এবং আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। ১৯৭৬ সালে তির্যক নাট্যগোষ্ঠী কর্তৃক রবিউল আলমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় চট্টগ্রামের প্রথম (এবং দেশের দ্বিতীয়) নাট্য ত্রৈমাসিক তির্যক। তির্যক নাট্য গোষ্ঠী চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নাটক প্রদর্শন করে দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে।
তির্যকের পথচলা বিরামহীন। দেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়কাল থেকে তির্যক নাট্য গোষ্ঠী আজও নাটকের মুকুরে স্বরূপ দর্শনে নিষ্ঠাবান।