আর্কটিক অঞ্চলের গভীর সমুদ্রে তিমির বাসস্থান আর চলাফেরার তথ্য সংগ্রহ করতে ফাইবার-অপটিক কেবলের সাহায্য নিচ্ছেন গবেষকরা। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করতে ব্যবহৃত হয় ওই একই ফাইবার-অপটিক কেবল। প্রচলিত সাইসমিক স্টেশনের যন্ত্রপাতি পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না, গভীর সমুদ্রের এমন ভূমিকম্প চিহ্নিত করতেও একই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেন গবেষকরা।
তিমি গবেষকরা আর্কটিকে এ ফাইবার-অপটিক কেবল ব্যবহার করছেন তিমির আওয়াজ চিহ্নিত করতে। সমপ্রতি সে গবেষণার ফলাফলও প্রকাশ করেছেন তারা। বন্যপ্রাণীর ওপর নজর রাখতে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিংস’ কৌশল ব্যবহারের এটাই প্রথম ঘটনা বলে দাবি করেছেন নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির বিজ্ঞানীরা। খবর বিডিনিউজের।
বিজ্ঞান সাময়িকী ফ্রন্টিয়ার্সে প্রকাশিত এ গবেষণা প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক এবং নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী লিয়া বুফো প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট ভার্জকে বলেন, যে অঞ্চলগুলোতে পৌঁছানো কঠিন, ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিংয়ের মাধ্যমে সেখানেও গবেষণা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। পৃথিবীর সমুদ্রগুলো গভীরে ছড়িয়ে আছে ৪২০টির বেশি সাবমেরিন কেবল। সব মিলিয়ে ১৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্য এসব কেবলের। এই বিশাল নেটওয়ার্কই ভূমিকম্প অথবা শব্দের ভিত্তিতে তিমির উপস্থিতি চিহ্নিত করার কাজে ‘ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিং’ কৌশল ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা দিচ্ছে।
তিমির সংখ্যা আর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বুফোর মতো তিমি গবেষকরা এতদিন হাইড্রোফোন প্রযুক্তি ব্যবহার করতেন। কিন্তু হাইড্রোফোনের রেঞ্জ সীমিত এবং ১০ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে ব্যবহার করতে হয়। অনেকটা মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক টাওয়ারের মতো কাজ করে। নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সিগনালের মাধ্যমে যেভাবে মোবাইল ফোনের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, ঠিক একইভাবে হাইড্রোফোন তিমির আওয়াজ চিহ্নিত করে।
কিন্তু সমুদ্রের ব্যাপকতা আর গভীরতার কারণে হাইড্রোফোনের বড় নেটওয়ার্ক দিয়েও গভীর সমুদ্রের খুবই ছোট অংশের ওপর নজর রাখা কঠিন। সে তুলনায় পুরো পৃথিবীর সমুদ্রতল জুড়ে ছড়িয়ে আছে ফাইবার-অপটিক কেবল। গভীর সমুদ্রে ডুবে থাকা কেবলগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা, তা বুঝতে ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেবল কোম্পানিগুলো। এ প্রযুক্তি কাজ করে কেবলের ‘ইন্টারোগেটর’ যন্ত্রাংশের মাধ্যমে। কেবল আদৌ কার্যক্ষম আছে কিনা সেটি বলে দেয় ইন্টারোগেটর। নির্দিষ্ট সময় পরপর কেবলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলোর ‘পালস’ পাঠায় ইন্টারোগেটর। কিন্তু শব্দ আর কম্পনের ফলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় ওই পালসের যাত্রাপথে। ফিরতি সিগনালে আসা পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে কেবলের ভেতরে বা আশপাশে কী ঘটছে তা বুঝতে পারেন গবেষকরা। কেবলের আশপাশে ভারী নোঙর পড়লে অথবা তিমি গান গাইলে সেটাও ধরা পড়ে যায় ইন্টারোগেটরের পালসে।
গভীর সমুদ্রের ভূমিকম্পও ধরা যায় একই প্রযুক্তিতে। ইন্টারোগেটরের পালস বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য-উপাত্তকে ভার্চুয়াল হাইড্রোফোন হিসেবে বর্ণনা করেছেন বুফো। কেবলগুলো ঠিক যেভাবে ভূমিকম্প চিহ্নিত করে, ঠিক একইভাবে তিমির পাখনায় প্রতিফলিত হয়ে আসা কম্পনও চিহ্নিত করতে পারে।
গবেষকরা বলছেন, তিমি দীর্ঘ ও স্বল্প কম্পনাঙ্কের আওয়াজের পালস সৃষ্টি করে। পুরুষ তিমির পাখনায় সে আওয়াজ প্রতিফলিত হয়েই তৈরি হয় তিমির গান। ‘ইভসড্রপিং অ্যাট দ্য স্পিড অফ লাইট : ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিং অফ বালিন হোয়েলস ইন আর্কটিক’ শীর্ষক এ গবেষণার কেন্দ্রে ছিল বালিন তিমি। সুমেরু অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি তিমির এ জাতটির ওপর কী প্রভাব ফেলছে তা বুঝতে এ গবেষণা ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীগুলোর একটি হলেও বালিন তিমি সম্পর্কে খুবই কম তথ্য রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে।
বুফো ভার্জকে বলেন, তিমিগুলো যা করছে এবং যেভাবে করছে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ প্রয়োজন আমাদের। তিমিগুলো কোনো নৌকা বা জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেলে, জেলেদের জালে আটকে গেলে অথবা নির্দিষ্ট অঞ্চল ছেড়ে ভিন্ন কোথাও গেলে ফাইবার-অপটিক কেবলের মাধ্যমে সেটাও চিহ্নিত করতে পারেন গবেষকরা। বাণিজ্যিকভাবে তিমি শিকার কমে আসার পর সমুদ্রে তিমির সংখ্যা আগের পর্যায়ে ফিরছে কিনা সেটা বুঝতেও কাজে আসবে ডিস্ট্রিবিউটেড অ্যাকোস্টিক সেন্সিং প্রযুক্তি।