গত শতকের নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশের অগণিত কিশোর–কিশোরীর সবুজ মনকে রোমাঞ্চে রাঙানো লেখক, তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান আর নেই। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। গতকাল বুধবার ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক ডা. মুহিব উল্লাহ খন্দকার বলেন, দুপুরের পর ডায়ালাইসিস করাতে এসেছিলেন রকিব হাসান। তবে ডায়ালাইসিস শুরুর আগেই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তিনি ওয়েটিংয়ে ছিলেন। অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালেই চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা হয়, কিন্তু বাঁচানো যায়নি। খবর বিডিনিউজের।
রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজ থেকে বাংলায় তিন গোয়েন্দার সূচনা হলেও রকিব হাসানের লেখনিতে তা ভিন্ন মাত্রা পায়। সেবা প্রকাশনী ১৯৮৫ সালে তিন গোয়েন্দা সিরিজ শুরু করার পর এ পর্যন্ত সাড়ে চারশর বেশি বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে দেড়শর বেশি বই লিখেছেন রকিব হাসান। গোয়েন্দা কাহিনীর বাইরেও তিনি বহু ক্লাসিক ও কিশোর সিরিজও উপহার দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার লেখা বইয়ের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক।
মূলত এক সময় পাঠকের হাতে স্বল্পমূল্যে বই তুলে দিতে এবং নিত্য–নতুন পাঠক সৃষ্টি করতে পেপারব্যাক সংস্করণে প্রকাশিত নামে–বেনামে তার লেখা বহু বই তিন দশক ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। সেবা প্রকাশনীর উপদেষ্টা মাসুমা মায়মুর এক ফেসবুক পোস্টে রকিব হাসানের মৃত্যুর খবর জানিয়ে লিখেছেন, তিন গোয়েন্দা ও সেবা প্রকাশনীর পাঠকদেরকে আন্তরিক দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে কিছুক্ষণ আগে রকিব হাসান সাহেব পরলোকগমন করেছেন। তিনি বলেন, তিনি (রকিব হাসান) বহু বছর ধরে অসুস্থ। গত ছয়–সাত মাস ধরে তার ডায়ালাইসিস চলছিল। প্রতি সপ্তাহে এক–দুইবার ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছিল। তিনি যখন দুর্বল হয়ে যেতেন, তখন তাকে বারবার আইসিইউতে নিতে হত। এর জন্য তার আর্থিক সমস্যাও তৈরি হয়। আমি এ নিয়ে সাহায্য চেয়ে ফেইসবুকে পোস্টও দিয়েছিলাম এর আগে।
১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় রকিব হাসানের জন্ম। বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলা কেটেছে ফেনীতে। বিএসসি পাস করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে। পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে চেষ্টা করলেও শেষে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রকিব হাসান। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত রহস্যপত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৭ সালে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ছদ্মনামে। অনুবাদগ্রন্থ ‘ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা’ তার নিজের নামে প্রকাশিত প্রথম বেই। এরিক ফন দানিকেন, ফার্লে মোয়াট, জেরাল্ড ডুরেল–এর মত বিখ্যাত লেখকদের অনেক চিরায়ত লেখা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অ্যারাবিয়ান নাইটস ও টারজান সিরিজের বাংলা অনুবাদও তার হাত দিয়ে এসেছে। অনুবাদ করেছেন জুল ভার্নের বইগুলোও। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে তার তিন গোয়েন্দা সিরিজ। এই সিরিজের তিন কিশোর গোয়েন্দা কিশোর, রবিন আর মুসা হয়ে উঠেছে বহু কিশোর তরুণের কল্পনার সঙ্গী। সেবা প্রকাশনী ছাড়ার পর ‘তিন বন্ধু’ ও ‘গোয়েন্দা কিশোর মুসা রবিন’ নামে এই সিরিজের বই লেখা চালিয়ে যান রকিব হাসান। নিজের নামে ‘কিশোর গোয়েন্দা’ সিরিজ, ‘খুদে গোয়েন্দা’ সিরিজ, এবং ছদ্মনামে ‘রোমহর্ষক’ সিরিজ ও ‘গোয়েন্দা রাজু’ সিরিজ লিখে গেছেন তিনি।
কিশোর বয়সে তিন গোয়েন্দা পড়া অনেকেই ফেসবুকে শোক প্রকাশ করেছেন। কাজী জেবুন্নেসা নামে একজন লিখেছেন, আমার ছেলেবেলার একটা বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে তিন গোয়েন্দা। এমনকি এখনো এই বয়সে এসেও তিন গোয়েন্দার সব খবর আমাকে সমানভাবে নাড়া দিয়ে যায়।