তিন গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া

চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি অপারেটর ৯ শতাংশ খরচ কমবে, ৭ শতাংশ গতি বাড়বে: বিশ্ব ব্যাংক

হাসান আকবর | রবিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বন্দরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি), পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) এবং বে টার্মিনাল পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ক্রমান্বয়ে বিদেশি অপারেটরদের প্রদান করা হবে। এর মধ্যে সৌদি আরব, দুবাই ও সিঙ্গাপুরের সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বন্দরে বিদেশি সরকারি অপারেটর নিয়োগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে গতি আনার পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগের আশায় সরকার বন্দরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশে ডলারের যে সংকট তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বিদেশি অপারেটরদের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে বন্দরের উন্নয়নসহ বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট সংগ্রহে বিদেশি অপারেটররা সরাসরি বিনিয়োগ করবে। ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআইয়ের এই প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মনে করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল, নতুন গড়ে ওঠা পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল এবং আগামী শতাব্দীর বন্দর হিসেবে বিচেচিত বে টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে সরকারি ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরে বলা হয়েছে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরে ৯ শতাংশ খরচ কমবে এবং ৭ শতাংশ গতি বাড়বে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় চট্টগ্রামই একমাত্র বন্দর, যেটি টুল পোর্ট (বন্দর পরিচালনার সব দায়িত্ব সরকারের)। অন্যদিকে বিশ্বের সব উন্নত বন্দর ল্যান্ডলর্ড (যেখানে বেশিরভাগ কাজ পরিচালিত হয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়, সরকার শুধু নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে)। চট্টগ্রাম বন্দর ল্যান্ডলর্ড মডেলে পরিচালিত হলে দেশের অর্থনীতি, আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য এবং বন্দরের সার্বিক কার্যক্রম গতিশীল হবে। বন্দরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিদেশি অপারেটর নিয়োগের তালিকায় রয়েছে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল, পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল, মাতারবাড়ী বন্দর ও বে টার্মিনাল। এর মধ্যে এনসিটিসহ নিউমুরিং ওভারফ্লো কন্টেনার ইয়ার্ড পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেসরকারি অপারেটর নিয়োগে প্রকল্প প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে।

এনসিটি পরিচালনার জন্য দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছে। ডিপি ওয়ার্ল্ড এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মোট ১৮টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের মধ্যে এই টার্মিনালে রয়েছে ১৪টি। এই টার্মিনাল বন্দরের বেশিরভাগ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে। ২০০৭ সালে প্রায় ৭শ কোটি টাকা ব্যয়ে এনসিটি নির্মাণ করা হয়। তবে নানা জটিলতায় এটি চালু করতে আট বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। পরে দেশীয় বেসরকারি টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেককে এটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে টার্মিনালটি সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনা করে।

পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের নির্মাণ কাজ সম্প্রতি সম্পন্ন হয়েছে। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এটি নির্মাণ করে। টার্মিনালটি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত চালু হয়নি। এই টার্মিনালে কোনো ইকুইপমেন্ট স্থাপন করা হয়নি। বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হলে টার্মিনালে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট স্থাপন করা হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এই টার্মিনালে নিজেরা কোনো ইকুইপমেন্ট স্থাপন না করে বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে ইকুইপমেন্ট স্থাপনের চিন্তাভাবনা করছে। বিদেশি অপারেটর নিজেরা ইকুইপমেন্ট স্থাপন করে বন্দর পরিচালনা করবে এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে টার্মিনাল হস্তান্তর করে চলে যাবে।

বিল্ড অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) ভিত্তিতে পতেঙ্গা টার্মিনাল অপারেশনের জন্য সৌদি আরবের রাজ পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) কাজ পেতে যাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতোমধ্যে এই কোম্পানির সাথে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আলাপআলোচনা শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি নিয়ে চলছে দর কষাকষি। এই টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের ব্যাপারে উপদেষ্টা হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনকে (আইএফসি) নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

আগামী একশ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচিত চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে সরকার। অপর একটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি পিএসএ। তবে এই টার্মিনালের একটি অংশ পরিচালনার দায়িত্ব পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে মাতারবাড়ি বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব জাপানের একটি অপারেটরের হাতে যাচ্ছে বলে আভাস দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালগুলো বিদেশি অপারেটরকে প্রদান করার ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে কাজে গতি আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দরের অনেক লোকের কোনো কাজ থাকবে না। এনসিটিতে বন্দরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইকু্‌ইপমেন্টগুলো স্থাপন করা রয়েছে। এগুলো বিদেশি অপারেটরকে দেয়া কতটুকু যৌক্তিক হবে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পিসিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান বন্দরের প্রবেশদ্বার। সেটি বিদেশি অপারেটরদের হাতে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তাভাবনা করা দরকার।

এদিকে চট্টগ্রামের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, বন্দরে বিদেশি অপারেটর নিয়োগে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। এতে গতি বাড়বে, খরচও কমবে। কিন্তু এতে অন্য কোনো সংকট তৈরি হচ্ছে কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে এবার পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৫০৫৭ জন
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় ব্রি ধান ২৮-এ নেক ব্লাস্ট রোগ