বিড়ালটি সবসময় তিন্নির সাথে থাকে। সে একে খুব আদর করে। মাঝে মধ্যে একটু দূরে থাকতে চাইলেও পারে না। এরা কাছে কাছে ঘুরাঘুরি করে। আশে পাশে থাকতে চায়। বিরক্ত হলেও পাশ ছাড়ে না। সে বের হলে তখন দরজা পর্যন্ত পিছু পিছু আসে। তার দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। সে একটু আদর করে বলে, আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। যাও তুমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো। তবে আমার বিছানায় উঠবে না। তোমার বিছানায় ঘুমাবে।
তিন্নির রুমে বিড়ালটির ছোট্ট একটি বিছানা। ওখানে সে ঘুমায়। তিন্নি না বললে তার বিছানায় কখনো উঠে না। বিছানার আশে পাশে ঘুরে। কিছুক্ষণ পর পর তিন্নির দিকে মুখ তুলে তাকায়। কি যেন বলতে চায়। সে বুঝতে পারে। বিড়ালটি বিছানায় উঠতে চায়। তার পাশে বসতে চায়। কখনো অনুমতি দেয় আবার কখনো দেয় না। তখন সে মুখ কাচুমাচু করে নীচে বসে থাকে। তিন্নির একসময় মায়া হয়। সে উপরে উঠতে বলে। অমনি এক লাফে উঠি তার পাশে গিয়ে বসে।
সে বিড়ালটির একটি নাম রেখেছে। মিন্নি। মার নামটি পছন্দ হয়নি। তোমার সাথে মিলিয়ে কেন বিড়ালের নাম রাখলে? তিন্নি মিন্নি শুনতে কেমন শুনায়। বাবা আবার সায় দিয়েছে। নামে কিছু যায় আসে না। ওর বিড়াল, ওর যা খুশি তা ডাকুক। এতে আমাদের বলার কিছু নেই। মা এবার বলে, বিড়ালটি ওর সাথে থাকে ঠিকই কিন্তু এর খাওয়া দাওয়া গোসল সবই আমাকে করাতে হয়। বাবা যুক্তি দেখায়। মেয়েতো এখনো ছোট, স্কুলে পড়ে। তার লেখাপড়া আছে না। একসময় দেখবে সে নিজে নিজে এসব করবে।
মিন্নি নামটা বসে যায়। সবাই এ নামে ডাকতে থাকে। বিড়ালটিও জানে তার নাম মিন্নি। শব্দটা শুনলে সে একবার তাকায়। তিন্নির ছোট ভাইটি এখনো কথা বলতে পারে না। ভাইটির নাম রন্নি। অনেক ছেলের নাকি কথা বলতে দেরী হয়। মার এটা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। ডাক্তারও দেখিয়েছে। অপেক্ষা করতে বলেছে। সবাইকে তার সাথে কথা বলতে পরামর্শ দিয়েছে। বিড়ালটিও ভাইটির পাশে পাশে ঘুরে। খানিক পর পর চোখ তুলে তাকায়। কথা বলতে চায়। তিন্নি স্কুলে গেলে বিড়ালটি ভাইয়ের সাথে সময় কাটায়।
তিন্নির স্কুলে অনেক ভাল লাগে। সহপাঠীদের সাথে গল্প করা যায়। কেউ কেউ মজার সব গল্প বলে। স্বপ্নে কি দেখছে তাও বলে। রঙিন সব স্বপ্ন। সাথে ভয় ভীতিরও স্বপ্ন। এ স্বপ্নের কথা অন্যরা মনোযোগ দিয়ে শুনে। শেষ হলে বলে তারপর। তিন্নি তার পোষা বিড়ালটির গল্প করে। সে যেন সারাক্ষণ তার সাথে থাকে। সে যেখানে যায় সেখানে তার চোখে ভাসে। বিড়ালটি তার একজন ভাল বন্ধু। তাকে অনেক সময় দেয়। কখনো মনে কষ্ট দেয় না। তবে মাঝে মধ্যে একটু দুষ্টুমী করে। এটা সেটা করে তাকে অনেক আনন্দ দেয়। সে বলে, আমি বিড়ালটির নাম রেখেছি মিন্নি। নামটা শুনে ওরা হো হো করে হেসে উঠে। তারপর সবাই একসাথে বলে, তিন্নির বিড়াল মিন্নি।
রন্নিও মিন্নিকে খুব পছন্দ করে। কথা বলতে না পারলেও দেখলে হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায়। খেলাধুলা করতে চায়। মিন্নি একেবারে তার কাছে চলে যায়। অনেকটা হাতের নাগালে। সে হাত পা ছুড়ে শব্দ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। মিন্নি তার খুব কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। খানিক পর পর মিউ মিউ শব্দ করে ডাকে। রন্নি অবাক নয়নে তাকায়। কান দুটি খাড়া করে রাখে। যেন বার বার শুনতে চায়। মিউ মিউ ডাক শুনে সেও শব্দ করে ডাকতে চায়। ঠোট দুটি কাঁপতে থাকে। গলা থেকে স্বরটা বের হতে পারে না। কোথায় যেন আটকে যায়। গলার ভেতর গড় গড় শব্দ করে। বোবা কান্নার মত শোনায়। শব্দটা মিন্নি শুনতে পায়। সে আবারও মিউ মিউ শব্দ করে ডাকে। এভাবে রন্নি মিন্নির ডাকা ডাকির খেলা চলতে থাকে।
স্কুল থেকে ফিরে এলে ভাইটি আর বিড়ালটিকে পায় না। তিন্নির পিছে পিছে রুমে ঢুকে যায়। তিন্নি এটা আবার পছন্ন করে না। বলে তুমি একটু পরে এসো। আমি স্কুল ড্রেস চেঞ্জ করবো। বিড়ালটি অসহায় দৃষ্টি মেলে তিন্নির দিকে তাকায়। সে আবারো বলে, তুমি একটু বাইরে যাও। এবার মিন্নি ঠিকই বাইরে চলে যায়। রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর তিন্নির ডাক শুনে আবার ভেতরে আসে। তিন্নি বাসার ড্রেস পড়েছে। মিন্নি তার দিকে তাকায়। সে এবার বলে, এমন করে কি দেখছে, আমাকে আগে দেখনি? মিন্নি চোখ দুটি তুলে শুধু তাকিয়ে থাকে।
প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে তিন্নি গুনে গুনে ত্রিশটা দড়ি লাফ দেয়। দড়ির দুপাশ দুহাতে ধরে লাফ মেরে পায়ের নীচ দিয়ে দড়িটা মাথার উপর ঘুরিয়ে আনে। সামনে দিয়ে ঘুরে দড়িটা আবার পায়ের নীচে চলে যায়। এভাবে লাফ মেরে মেরে দড়িটা উপরে নীচে ঘুরতে থাকে। আর মুখে এক দুই তিন বলতে থাকে। এসময় বিড়ালটাও তার সাথে লাফাতে থাকে। এটা যেন তাদের একটা খেলা। এতে সে খুব আনন্দ পায়। মিন্নিও কম আনন্দ পায় না। সেও যেন প্রতিদিন এ লাফালাফির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ত্রিশ লাফ শেষ করে তিন্নি ওয়াশ রুমে ঢুকে যায়। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভাল করে গোসল করে নেয়। মিন্নি ওয়াশ রুমের দরজার কাছে বসে থাকে।
গোসল সেরে তিন্নি সোজা খাওয়ার টেবিলে চলে যায়। অনেক ক্ষিধে লেগেছে। ভাল করে খেতে হবে। মিন্নিও আর বসে থাকে না। খাওয়ার টেবিলের আশে পাশে ঘুরতে থাকে। মাঝে মধ্যে মাথা উঁচু করে সামনের দুপা উপরের দিকে তুলে দিয়ে তিন্নির কোলের কাছে আসতে চায়। সে সুযোগ দেয় না। বলে তোমার খাওয়া এখন না। একটু পরে আমার খাওয়া শেষ হলে। তবে তোমার জন্য আজ অনেক মজার খাবার আছে। তার দিকে তাকিয়ে যেন জানতে চায় কি খাবার? মাছ। বুঝেছো মাছের কাটা, তোমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তুমিতো আবার দুধও খুব পছন্দ কর। মাতো তোমাকে রোজই দুই বাটি দুধ খাওয়ায়। তুমি চুক চুক করে খেয়ে নাও। তিন্নি মাছের কাটা সব আলাদা করে রাখে। খাওয়া শেষ হলে তাকে দেবে। তার আলাদা প্লেট আছে। সে প্লেটে না দিলে মিন্নি আবার খেতে চায় না। তার খাবার বাটিও আলাদা।
বিকেলে তিন্নির টিচার আসে। সে বই খাতা নিয়ে টিচারের কাছে পড়তে বসে। তার সাথে বিড়ালটাও পড়ার রুমে চলে যায়। টিচার স্কুলের পড়াগুলো বুঝিয়ে দেয়। খাতা খুলে অংক করায়। মিন্নি দূরে বসে থাকে। চুপচাপ বসে থেকে তাকিয়ে থাকে। ঘুরাঘুরি করে না, এমনকি নড়াচড়াও করে না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন পাহারা দিচ্ছে। কাকে পাহারা দিচ্ছে? তিন্নিকে নাকি টিচারকে। নাকি কেমন পড়ায় দেখছে। তিন্নি অবশ্য মাঝে মধ্যে ওর দিকে তাকায়। টিচার তখন বলে, বিড়ালটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে বলে, ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। টিচার আর কথা বাড়ায় না। বলে পড়, মন দিয়ে পড়। এদিক ওদিক তাকালে পড়া থেকে মনোযোগ ছুটে যায়।
টিচার চলে গেলে তিন্নি ড্রয়িং রুমে চলে আসে। তার পায়ে পায়ে মিন্নি এসে ঢুকে। তিন্নি শোফায় বসে টিভিটা অন করে। এসময় সে কার্টুন ছবি দেখে। কার্টুন ছবি তার অনেক প্রিয়। কিছুক্ষণের মধ্যে কার্টুন ছবির ভেতর সে নিজেও ঢুকে যায়। নিজেকে ওদের মত মনে করে। আহা কি আনন্দ! কত রকম স্বপ্ন, কত রঙের মেলা। শুধু চোখে নয় মনটাও যেন জুড়ে যায়। মিন্নির কথা আর মনে থাকে না। সেও কিন্তু টি টেবিলের পাশে বসে এক মনে দেখছে। তিন্নির মত হয়ত মন প্রাণ দিয়ে ডুবে যেতে পারছে না। কিন্তু দেখতে ভাল লাগছে। আনন্দও পাচ্ছে। কখনো চোখ বুজে আসছে না।তবে সে মাঝে মধ্যে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে তিন্নির দিকে তাকায়।
রন্নির সাথে সবাই কথা বলতে চায়। তার কাছে গিয়ে এটা সেটা বলে। হাত নেড়ে কথা বলে। আঙ্গুঁল দিয়ে এটা ওটা দেখায়। সে ঠিকই দেখে। হাতও নাড়ে কিন্তু কথা বলতে পারে না। মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। মাতো সারাক্ষণ চেষ্টা করে কথা বলাতে, বাবাও। তিন্নিও ভাইকে অনেক আদর করে। গালে গালে চুমু খায়। মাঝে মাঝে ঠোঁটের সাথে ঠোঁটও লাগায়। সে আ ও করে জবাব দিতে চায়। কিন্তু কোন শব্দ মুখ থেকে বের হয় না। কখনো ছোট ছোট পা দুটি ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। একধরনের গো গো শব্দ করতে থাকে।
মিন্নির সাথে তার সময়টা ভাল কাটে। মিন্নি কাছে থাকলে অনেক আনন্দে থাকে। তার পাশে পাশে ঘুরলে সে কথা বলতে চেষ্টা করে। গলায় ভেতর কি যেন উঠানামা করে। ছোট্ট ঠোঁট দুটি বার বার কেঁপে উঠে। মিন্নিও যেন ঘরের অন্য সবার মত তার মুখে কথা ফোটাতে চায়। সে চার পাশে ঘুরে ঘুরে বার বার তার দিকে তাকায়। রন্নি হাত পা নেড়ে ঘুরে ঘুরে তাকে ধরতে চেষ্টা করে। সে ধীরে ধীরে তার কাছে চলে আসে। একেবারে গা ঘেষে দাঁড়ায়। কচি হাত দুটি দিয়ে তার মোলায়েম লোমগুলো স্পর্শ করে। তখন মিন্নি মিষ্টি স্বরে ডাকতে শুরু করে। মিউ মিউ। কোমল স্বরটা রন্নির কন্ঠে অনুরনিত হয়ে মিউ মিউ শব্দে প্রতিধ্বনিত হয়। তখন মিন্নির ডাকের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে রন্নি বলতে পারে ‘মিউ মিউ’।