আজ আমাদের ঘরে বয়ে যেতো আনন্দের ধারা। রচিত হতো এক স্বপ্নচারী কিশোরের ভবিষ্যৎ, আত্মীয়–স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী সবার আনন্দের উৎস হতে পারতো সে। ফুল হয়ে সুবাস ছড়াতে পারতো পৃথিবীময়। সম্প্রতি এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। তাসিন এ প্লাসও পেলো খুশির বদলে শুরু হলো মাতম, আহাজারি। আমাদের সবার আগে সেই চলে গেলো। কত সুন্দর তরতাজা একটা প্রাণ, কতই আর বয়স। সবে সে এ বছর সালে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছিল। গত ১৪ই জুন শনিবার একই কলেজের সাত বন্ধু গিয়েছিল সীতাকুণ্ড ঘুরতে। সহশ্রধারা–০২ ঝর্না দেখা শেষ করে সবাই বাসায় ফিরবে। হঠাৎ কি চিন্তা করে বন্ধুদের কয়েকজনের মধ্যে লেকের পানিতে নামার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। ওরা কেউ বুঝতে পারেনি যেখানে নামছে সেখানে পানি অনেক গভীর ও ঠাণ্ডা। ভালো কোন দিক নির্দেশনাও ছিল না। দুর্ঘটনাক্রমে তাসিন সেই পানিতে হারিয়ে যায়। বাবা মায়ের আদরের মানিক চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে তাকে নিয়ে সকল স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে যায়। একটা সম্ভবনাময় কিশোরকে হারালো পরিবার, সমাজ ও দেশ।
মেধা, মননে, ধর্ম পালন, ক্রিয়া, ও প্রোগ্রামিং খুবই ভালো ছিল। স্বল্পভাষী, অতি নম্র ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য এলাকার সব বয়সের মানুষজনের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। বন্ধুমহলেও খুব জনপ্রিয় ছিল।
কখনো কেউ যখন আমাকে সু–সন্তানের পিতা বলতো, তখন গর্বে বুকটা ভরে যেত। স্রষ্টার কাছে নীরবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতাম। ডিওএইচএস এলাকার মসজিদে ফযরের জামাতে ওর বয়সে শুধু তাসিনকে পাওয়া যেত। একবার এক মুরুব্বির সাথে নামায পড়ে মসজিদ থেকে হেঁটে বাসায় পৌঁছে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে আর ঔ ভদ্রলোক ভিজে যাচ্ছে। তাসিন সাথে সাথে একটা ছাতা নিয়ে বের হয়ে গেল এবং ওই মুসল্লিকে বাসায় পৌঁছে দিলো। এত ছোট বয়সে সুন্দর একটা ধার্মিক জীবন যাপন করতো দেখলে অবাক লাগতো।
ট্যালেন্টফুলে বৃত্তি পাওয়া ছেলেটা পড়ালেখার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং–এ ভালো ছিল। গণিত ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতো এবং ভালো করতো। স্কুলে একবার উপস্থিত গল্প বলা প্রতিযোগিতা হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হয়ে ঢাকা শিশু একাডেমি থেকে পুরস্কার প্রাপ্ত হয়।
খেলাধুলাতেও ভালো ছিল। স্কুলে ফুটবল, ক্রিকেট ও বাস্কেট বল খেলতো। ওর মৃত্যুর পর স্কুলের ছেলেরা আমার কাছে আসে। কয়েকজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে, ওরা কিছু দিন পূর্বে ফুটবল প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করে। তাসিন নাকি একাই দুইটা গোল করে জয়ের সফলতা এনে দিয়েছিল।
গত বছর জুলাই–আগস্টের বিপ্লবের সময় সারা দেশে ছাত্র জনতার উত্তাল আন্দোলন চলছিল। তাসিন তখন বার বার বাসা থেকে বেরিয়ে যেত। সারা দিন খবর রাখতো ওর বয়সের বন্ধুরা কোথায় কখন মিছিলে গেল। কয়েকটা মিছিলেও গিয়েছিল কাউকে কিছু না বলে। সারাদেশে কারফিউ ঘোষিত হলো। একদিন হঠাৎ ছুটে এসে বলল ওর এক বন্ধুর গায়ে গুলি লেগেছে এখনই তাকে দেখতে যাবে বলে চলে গেল। অগাস্টের তিন তারিখে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্রদের অনুরোধে আমেরিকা ঢাকার গণভবনের আকাশে উপর শক্তিশালী একটা স্যাটেলাইট সেট করেছিল। তথ্যটা ওর কাছ থেকে প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম।
চাকরিজীবী বাবা মায়ের সন্তানদের ছোটবেলা থেকে দৈনন্দিন জীবনের অনেক বাস্তবতার সাথে সংগ্রাম করে চলতে হয়। তাসিনের মা সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে বদলি হতো। ঘন ঘন স্কুল পরিবর্তনে লেখা পড়ার মনোযোগ ও ধারাবাহিকতার সমস্যা হয়। সেই ছোট বেলা থেকে চট্টগ্রামে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা চলিয়ে যাওয়ার জন্য উইক এন্ডে ও ছুটির দিনগুলোতে মায়ের বদলি স্থলে ছুটতে হতো।
কম্পিটার ও ইলেকট্রনিকের প্রতি দারুন আগ্রহ ছিল তাসিনের। ওর কাছ থেকে নানাবিধ প্রযুক্তির নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যেত। প্রোগ্রামিংও ভালো ছিল। ছোট বেলা থেকে ও খুব শান্ত, ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী ছিল। যে কোন মানুষের সাথে মিশতো পারতো বলে, একবার দেখলে ওর খবর নিয়ে বলতো আপনার ছেলেটা সত্যিই চমৎকার। ও ভালো আছেতো।
একটা সম্ভবনাময় উদীয়মান সন্তানকে পর্যটন স্পটের দুর্ঘটনায় হারানো সত্যিই কঠিন কষ্টের। বাংলাদেশের যত্রতত্র নতুন নতুন গড়ে উঠা পর্যটন স্পটগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জীবন নিরাপত্তা নির্দেশাবলী ও ব্যবস্থা থাকে না। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রয়োজনে ভালোভাবে প্রতিবন্ধকতা দিতে হবে যাতে সহজে কেউ যেতে না পারে। পর্যটকদের পানিতে জীবন সুরক্ষার লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোট ও নিরাপত্তা সামগ্রী রাখতে হবে ও সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ২৫ জুলাই জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব পানিতে ডুবা প্রতিরোধ দিবস পালিত হবে। আমাদের দেশে বিষয়টা এখনো ততটা প্রচার পায়নি।
তাসিন তোর অনেক গুণ ছিল। নরম ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য তোকে সবাই পছন্দ করতো। আমার জীবনে একটা কিশোরের জন্য এত মানুষকে কান্না করতে ও দোয়া করতে দেখিনি। ওপারে ভালো থাকিস বাবা।
লেখক: প্রকৌশলী, তাসিনের বাবা।