সুফি এবং তাসাওউফ : সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই তাসাওউফের ধারা বহমান ছিল। হযরত আদম (আ.)’র উপাধিই সফিউল্লাহ্। পৃথিবীতে আসার কারণ হিসেবে আদম–হাওয়ার জীবন ধারায় যে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছিল তার জন্য কঠিন রিয়াজত সম্পন্নের মাধ্যমে তিনি যে অনুশোচনা এবং অনুতাপে দ্বগ্ধ হয়েছিলেন তার পুরস্কার হিসেবে এই উপাধি লাভ করেন। তাসাওউফ সাধনার প্রধান দুটো দিক। প্রথমত, আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনের জন্য কঠোর সাধনা করা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ্ প্রদত্ত নীতি বহির্ভূত অনৈতিক কামনা–বাসনা থেকে নির্লিপ্ত থাকা এবং সৃষ্টির কল্যাণে কাজ করা। সাধনার দিকটির প্রাথমিক দৃষ্টান্ত হিসেবে হযরত আদম (আ.)’র কঠোর রিয়াজতের জীবনকে ধরা যায়। আর অনৈতিক কামনা–বাসনা থেকে নির্লিপ্ত থাকা এবং ঝগড়া ফ্যাসাদে নিজেকে না জড়ানোর প্রাথমিক দৃষ্টান্ত হিসেবে কাবিল এবং হাবিলের নৈতিক অবস্থানের পারসপরিক বিরোধী কর্মকে বিবেচনায় আনা যায়। কাবিলের ধমকানিতে হাবিল খোদায়ী নীতি হতে বিচ্যুত হননি। কাবিলের বেপরোয়া আচরণে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিয়ে ঝগড়া থেকে নিজেকে নিবৃত রেখেছেন হাবিল। এমনকি হত্যার আগ মুহূর্তেও হাবিল কাবিলকে বলেছিল– “আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত তুলব না। আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ্কে ভয় করি” (সুরা মায়েদা–২৮)। এভাবেই তাসাওউফের ধারা হযরত আদম থেকে শুরু হয়ে আল্লাহ্ প্রেরিত নবী–অলিগণের চর্চার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে আসছে আবহমান কাল ধরে। নানা মতবাদিক দ্বন্দ্ব–সংঘাত এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিমজ্জিত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই পৃথিবীতে এখনো যেটুকু নীতি–নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবতাবোধ অবশিষ্ট আছে তা মূলত পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাসাওউফ পন্থী সাধকদের বিচরণেরই অবদান।
খোদাপ্রেম : রূহ জগতে সৃষ্টিকুলের সকল রূহ্ আল্লাহ্র সান্নিধ্যেই ছিল। কিন্তু আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য এবং যথার্থ দরদ–ভালবাসা প্রকাশের উপযুক্ত স্থান পৃথিবী। তাই আল্লাহ্ তায়ালা সকল রূহ্কে ক্রমানুসারে পৃথিবীতে প্রেরণ করার ব্যবস্থা করেছেন। আবার মানুষ যাতে পৃথিবীতে এসে আল্লাহ্র কথা বিস্মৃত না হয় তার জন্য নবী–রাসুলগণের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছেন বার বার। তাঁরা মানুষের অন্তরে খোদাপ্রেমের অগ্নি প্রজ্বলনের দায়িত্ব পালন করেছেন যুগ যুগ ধরে। আর আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সৃষ্টির আড়ালে একান্তে নিরীক্ষণ করছেন– চোখের অন্তরালে থাকা স্রষ্টার প্রতি মানুষের ভালবাসার মাত্রা কতটুকু তা। কথায় আছে– চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল। এই বাস্তবতা অনেকের ক্ষেত্রে প্রমাণিত। তারা পৃথিবীতে এসেই স্রষ্টার সাথে তাদের অবিনশ্বর ভালোবাসার যে সম্পর্ক রয়েছে সে সম্পর্কের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে এই নশ্বর পৃথিবীর চাকচিক্যে মোহাবিষ্ট হয়ে নানা ভ্রষ্টকর্মে জড়িয়ে পড়ে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে ঘটে এর ব্যতিক্রম। তাঁরা স্রষ্টার সাথে মানুষের প্রেমানুগত্যের সম্পর্কের কথা বিস্মৃত হন না। খোদা–প্রেমের অগ্নি তাঁদের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত থাকে সর্বক্ষণ।
সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা : মানুষের কাছে মানুষের প্রাণ যাতে নিরাপত্তাহীন হয়ে না পড়ে সেজন্য তাঁরা ধৈর্য, সংযম এবং সহিষ্ণুতার বাণী নিয়ে ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর নানা প্রান্তে। খোদার সৃষ্ট এই পৃথিবী যেন অশান্ত–বিক্ষুব্ধ হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত না হয় সেজন্য মানুষে মানুষে সম্প্রীতি গড়ে তোলার পয়গাম বয়ে বেড়ান সুফিয়ায়ে কেরাম। এভাবেই তাঁরা সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেন আল্লাহ্র প্রতি ভালবাসারই অংশ হিসেবে।
শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) : বিশ্ব তাসাওউফ দর্শনের অন্যতম জাগ্রত প্রাণকেন্দ্র মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফ। এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণপুরুষ হলেন গাউসুল আযম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারী (ক.)। আর বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.) হলেন তাঁর প্র–পৌত্র এবং এই দরবারের আধ্যাত্মিক সুফি–সাধকদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পিতা গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর পৌত্র এবং মনোনীত সাজ্জাদানশীন খাদেমুল ফোক্বারা হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (ক.)। মাতা হলেন গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর প্রধান খলিফা এবং আপন ভ্রাতুষপুত্র গাউসুল আযম বিল বিরাসাত হযরত মাওলানা শাহ্ সুফি সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র কনিষ্ঠ কন্যা। সেই হিসেবে তাঁর পিতৃ–মাতৃ বংশলতিকায় তাসাওউফের পুত–পবিত্র ধারা বহমান। তাসাওউফ পরিমণ্ডলে জন্ম এবং বেড়ে উঠার কারণে চারিত্রিক দিকগুলো তাঁর মাঝে নিহিত ছিল একেবারে শিশু–কিশোর কাল থেকেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি হয়ে প্রকাশ এবং বিকাশ ঘটেছে। পরিমিত কথা, বড়দের শ্রদ্ধাপূর্ণ এবং ছোটদের স্নেহসূচক সম্বোধন, অনাড়ম্বর জীবন, গভীর চিন্তামগ্নতা, ধৈর্য্য ও সহনশীলতা, মানবিকতা, প্রাণীর প্রতি অনুকম্পা, প্রতিবেশিকে সহযোগিতা, মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, হতাশাগ্রস্তের হৃদয়ে আশা জাগানো, দরিদ্র–সুবিধা বঞ্চিতদের সহায়তা ইত্যাদি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের রব্বানী দিক। মাতৃভক্তির অন্যতম মূর্তপ্রতীক ছিলেন তিনি। মায়ের বিশ্রামের সময় সামান্য জুতোর শব্দতেও যেন ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে তাই মায়ের কক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি জুতো পড়ে যেতেন না এবং ছোট ভাই বোনদের প্রতিও তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল– মা ঘুমানোর সময় মায়ের কক্ষের সামনে দিয়ে হাঁটাচলা করতে হলে জুতো হাতে নিয়ে চলতে হবে। ছোট–বড়, ধনী–দরিদ্র, উঁচু–নিচু, এমনকি মেথর তথা পরিচ্ছন্ন কর্মীদেরকেও ‘আপনি’ করে সম্বোধন করতেন। এর মাধ্যমে তিনি মানুষের মাঝে নানা বৈষম্যের মনোভাব ভুলে গিয়ে সবাইকে খোদার সৃষ্টি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে বিবেচনা করার মহান শিক্ষা দিয়েছেন। বার বার হজ্ব করতে যাওয়া ব্যক্তিকে পার্শ্ববর্তী অভাবগ্রস্ত প্রতিবেশীর অভাব মোচন করাও যে তার দায়িত্বের অংশ তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে লোভ–লালসা মুক্ত করে তাদের মধ্যে স্রষ্টানুরাগ জাগ্রত করে চরিত্র শুদ্ধির ব্যবস্থা করতেন। দুনিয়ার মোহে মানুষ যাতে অন্ধ হয়ে না যায় তাই তিনি মানুষকে বলতেন– এই দুনিয়া তো মুসাফিরখানা। আবার কখনো গাইতেন–
দুনিয়াকো লাথ্ মারো দুনিয়া সালাম করে
যুগ যুগ সালাম করে, বিজ বিজ সালাম করে
দুনিয়াকি ডরায়গি তো দুনিয়া দাবায়গি
মানুষ যেন কর্মহীন বেকার না থাকে তাই কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। অনৈতিক উপায়ে উপার্জন থেকে বিরত থেকে হালাল পথে উপার্জন এবং সকল বিপদাপদে আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল করার দীক্ষা দিতেন। তাঁর সুপ্রসিদ্ধ বাণী– ‘হালাল খাও, নামায পড়, আল্লাহ্ আল্লাহ্ জিকির কর – সব সমস্যা মিটে যাবে’। বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো– কঠোর রিয়াজত। মাঘ মাসের রাতে কনকনে ঠাণ্ডায় যখন মানুষ লেপ–কাঁথার নিচে টিকতে পারে না তখন তিনি পুকুরের মধ্যে সীনা পানিতে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছেন রাতের পর রাত। উত্তপ্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার কখনো নিজ কক্ষের দরজা–জানালা বন্ধ করে খোদার প্রেমে নিমগ্ন সময় কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। এভাবেই তিনি কঠোর রিয়াজতের মাধ্যমে স্রষ্টার এবং সৃষ্টি রহস্যের মর্ম উপলব্ধিতে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। নিজেকে উন্নীত করেছেন মানবতার সর্বোচ্চ মকামে। তিনি উরুজিয়তের সে স্তরে পৌঁছেছেন যে স্তরে পৌঁছালে হাদিসে মতে বান্দার চোখ আল্লাহ্র চোখ, বান্দার কান আল্লাহ্র কান, বান্দার হাত আল্লাহ্র হাত এবং বান্দার পা আল্লাহ্র পা–তে পরিণত হয়ে বান্দা সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহ্র কুদরতের রহস্য প্রকাশের মযহারে রূপান্তরিত হন। বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)’র ষাট বছরের গোটা জিন্দেগীর প্রতিটা ক্ষণ কেটেছে তাসাওউফ, খোদাপ্রেম এবং সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।