তালাকের পর স্বামী-স্ত্রী মনে করে জিতে গেছি, কিন্তু হেরে যায় সন্তান

মো. দিদারুল আলম | মঙ্গলবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:০৩ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক অবক্ষয়ের নতুন নাম পরকীয়া। অবাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সহজ যোগাযোগে তথাকথিত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই প্রেমের সম্পর্কে যোগ হয় লুকোচুরি করে শারীরিক সম্পর্ক। অতঃপর সাজানো গোছানো সংসার সম্পর্ক ভেঙে শুরু হয়, নতুন স্বপ্নের জগতে যাত্রা। যে যাত্রায় ধ্বংস হয় পরিবার ব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, প্রভাব পড়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভিত্তির ওপর। শুধু পরকীয়ার কারণে প্রতি বছর অনেক নারীর মৃত্যু হয়। গৃহবধূ ছাড়াও স্বামী এবং স্বজনরাও এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে থাকে। এমনকি গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে শুরু করে শহুরে সমাজের বিত্তবান অনেক পরিবারে পরকীয়ার থাবা পড়েছে। তালাকের অন্যতম কারণ হলো এই পরকীয়া। স্বামীস্ত্রী সম্পর্ক বিশ্বাসঅবিশ্বাসের দোলাচলে পরকীয়া নামক ব্যাধি ভেঙে দেয়। সংসার ভাঙার পাশাপাশি এর কারণে অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও শোনা যায়। ঘটনায় প্রকাশ, কেউ পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে হত্যা করছে স্ত্রীকে, আবার কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী তার প্রেমিক বা ভাড়াটে লোক দিয়ে খুন করাচ্ছে তার স্বামীকে। এমন স্বামীও রয়েছে, যে পরকীয়ার কারণে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সামনে খুন করেছে তাদেরই আরেক সন্তানকে।

পরকীয়ার কারণে কোনো সাজানো ঘরই ভাঙে না। ঘর অগোছালো হলেই পরকীয়ার জন্ম হয়। একসময় সেই অগোছালো ঘর ভেঙেও যায়। প্রত্যেকটি পরকীয়ার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে। একজন বিবাহিত নারী বা পুরুষ যদি মনোদৈহিকভাবে ভালো থাকে তাহলে তাকে পরকীয়ার দিকে যেতে হয় না। একটি নারী যদি দিনের পর দিন তার স্বামীর কাছ থেকে অবহেলা পায়, তেমনি স্বামী যদি স্ত্রীর কাছ থেকে অবহেলা পায়, সেখানে তৃতীয় কেউ মনের গহীনে প্রবেশ করে স্থান করে নেয়। ২০২৩ সালের অক্টোবরের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০২২টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। যদিও এটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের হিসাব, এটি বিবাহবিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হার নির্দেশ করে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিসি আদালতে জমা দেওয়া বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মেয়েদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক বা দ্বিতীয় বিয়ে, মতের বনিবনা না হওয়া, শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য, স্বামীর মাদকাসক্তি ইত্যাদি। আর ছেলেদের আবেদনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, অন্য পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক, সংসারে মানিয়ে না চলা ও স্বামীর কথা না শোনা ইত্যাদি।

বর্তমানে প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে, যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সত্যিই বেমানান। মুসলিম আইনের অধীনে বিবাহ একটি নাগরিক চুক্তি এবং এই চুক্তির মাধ্যমে দম্পতি একটি সুন্দর সংসার করার শপথ নেয়। স্বামীস্ত্রীর মধ্যে কোনো রক্তের বন্ধন নেই, তবুও তাদের পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা সারাজীবন একটি সুন্দর সংসার করতে অনুপ্রাণিত করে। বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন যা স্বামীস্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর স্থায়ী হয়। খুব নির্দিষ্ট কারণে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে তা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, এমনকি কোরআনেও। বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই কাম্য হতে পারে না কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা এখন আমাদের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঘটছে।

পরকীয়ার মতো খারাপ কাজ এড়াতে যা করতে পারেন, যেমন ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলা, স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই পরিবারের কাজ ভাগ করে নেওয়া, একে অপরের কাজের প্রশংসা করা উচিত, স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরের সমালোচনা করা, কিছু ভুল হলে তাদের ক্ষমা করার মানসিকতা থাকা, তাদের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক করা উচিত নয় এবং সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলেও নিজেকে সংযত করার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। সঙ্গীকে সময় দেওয়া এবং মিষ্টি করে কথা বলা স্বামীর কর্তব্য। উভযয়েই তাদের রাগ এবং বদমেজাজ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।

বিবাহ বিচ্ছেদের বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, আমরা অতিমাত্রায় উচ্চবিলাসী হয়ে গেছি। এই পুঁজিবাদি বিশ্বের যত ধরনের উপকরণ আছে, বিভিন্ন বিনোদন উপাদান যে মাধ্যমেই আসুক না কেন, তা আমাদের যেভাবে ভোগ বিলাসের দিকে তাড়িত করছে, এটা পুঁজিবাদি বিশ্বের লুম্পেন কৌশল। অর্থাৎ যেনতেনভাবে আয় করার কৌশল। পুরো পৃথিবীর অর্থ ও ক্ষমতা তারা কুক্ষিগত করতে চায়। এজন্য তারা তাদের পণ্যগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে দেয় যে, আমাদের মেয়েরা সে সবের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু আমাদের ছেলেদের সেই চাহিদা পূরণের সামর্থ থাকে না। প্রত্যেক ছেলে চায় তার স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে। কিন্তু সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব হয় না। স্ত্রীর বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে না পারলে স্ত্রীর সাথে একটা মনস্তুাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। সেটা আর্থিক, সামাজিক এবং বিনোদন প্রক্রিয়ার নেতিবাচক দিক হিসেবে আসছে।

বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ স্বামীস্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া। স্ত্রীর করা আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের স্বপক্ষে যেসব কারণ দেখানো হয়, তার মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, ফেসবুকে আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ আরও বিভিন্ন কারণ। অন্যদিকে স্বামীর আবেদনে বিবাহ বিচ্ছেদের স্বপক্ষে দেখানো হয় অবাধ্য হওয়া, ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ।

চট্টগ্রামে প্রতিদিন যে হারে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। এতে দেখা যায়, মাদক ও মোবাইল ফোনে আসক্তি, মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে মেয়েরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পর একক সিদ্ধান্তে বিবাহ বিচ্ছেদের পথ বেছে নিচ্ছে। তালাক কোনো সমাধান নয়, বরং এটি একটি নিন্দিত কাজ এবং শেষ উপায়। দাম্পত্য কলহ নিরসনে অন্যান্য সব পদ্ধতি ব্যর্থ হলে এবং নিরুপায় হলে ইসলামে তালাকের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সন্তানরা হেরে যায় এবং সারাজীবন তাদের এর ভার বইতে হয়।

লেখক : শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যলেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবপাচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধদেশের উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতি জরুরি