তালপাতার পাখায় শত বছরের জীবনগাথা

জব্বারের বলী খেলার মেলায় ৫ লাখের অধিক বিক্রি হয় চন্দনাইশের এ পাখা

চন্দনাইশ প্রতিনিধি | রবিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

চৈত্র-বৈশাখ মাসের এই সময়ে তীব্র গরম। তাই সাধারণ মানুষ একটু শীতল হাওয়া পেতে হাত বাড়ায় হাতপাখার দিকে। হাতপাখার শীতল বাতাস ক্লান্ত শরীরে এনে দেয় স্বস্তি। বর্তমানে দেশের প্রতিটি হাট-বাজার, রাস্তাঘাটে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে হাতপাখা। বিশেষ করে এখন তালপাতা দিয়ে তৈরি হাতপাখার কদর একটু বেশি। আর এসব তালপাতার হাতপাখা তৈরি হয় চন্দনাইশ পৌরসভার জিহস ফকিরপাড়া গ্রামে। এ গ্রামের ১ হাজারেরও বেশি পরিবার বংশানুক্রমে তালপাতার হাতপাখা তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে। হাতপাখা বিক্রি করে বর্তমানে অনেক পরিবার এখন স্বাবলম্বী। জিহস ফকিরপাড়ার মৃত সিরাজুল ইসলামের পুত্র মো. নাসির উদ্দিন (৩৫)। বর্তমানে তিনি দুবাই প্রবাসী। তিনি জানান, মাত্র কয়েক বছর আগেও তাদের পরিবারের সদস্যরা তালপাতার হাতপাখা তৈরি করতো। প্রতিবছর প্রচুর হাতপাখা পাইকারদের নিকট বিক্রি করতো। তিনি নিজেও হাতপাখা শিল্পী ছিলেন। তালপাতার হাতপাখা বিক্রির টাকায় মূলত তিনি এখন দুবাই প্রবাসী।

এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে হাতপাখা তৈরির কাজে সকল বয়সের নারী, পুরুষ, যুবক, যুবতী এমনকি শিশু কিশোররা পর্যন্ত নেমে পড়ে। গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক পরিবারের সবকটি পরিবারই হাতপাখা তৈরির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্থানীয়রা জানায়, আধ্যাত্মিক সাধক জিহস ফকিরের নামানুসারে জিহস ফকিরপাড়া হিসাবে নামকরণ করা হলেও চন্দনাইশ পৌরসভার এই পুরো গ্রামটিই বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে পাখাগ্রাম হিসেবে।

এ গ্রামের পাখাশিল্পীরা জানান, শীত মৌসুম ছাড়া সারা বছর হাতপাখার চাহিদা থাকে। বিশেষ করে চৈত্র বৈশাখ মাসে চাহিদা তিন-চারগুন বেড়ে যায়। গ্রামের প্রতিটি পরিবার এ মৌসুমে (চৈত্র-বৈশাখ মাসে) কম করে হলেও গড়ে লাখ টাকার হাতপাখা বিক্রি করে থাকেন।

পাখা শিল্পী বদিউল আলম জানান, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বার মিয়ার বলী খেলা উপলক্ষে আয়োজিত লালদিঘির মেলায় হাতপাখার বিশাল একটি বাজার বসে। পাখাশিল্পীদের তৈরি হাতপাখার সিংহভাগ বিক্রি হয় সেখানে। লালদিঘির মেলায় চন্দনাইশের পাখাগ্রামে তৈরি কমপক্ষে ৫ লাখ হাতপাখা বিক্রি হয় বলে জানা যায়। এছাড়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে মাইজভান্ডার ওরশ শরীফ ও আনোয়ারার মোহছেন আউলিয়ার বার্ষিক ওরশ শরীফ, বাংলা নববর্ষ ও দেশের বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠিত মেলা, বলী খেলা, গরুর লড়াই ইত্যাদিতে হাজার হাজার হাতপাখা বিক্রি হয়। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে এখানকার হাতপাখা বিদেশেও রপ্তানী হয় বলে জানান পাখাশিল্পীরা।

পাখা শিল্পীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, হাতপাখা তৈরির প্রধান উপকরণগুলো হলো তালপাতা, বাঁশ, বেত ও রং। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোর বনাঞ্চল থেকে বাঁশ ও বেত সংগ্রহ করতে হয়। আর হাতপাখা তৈরির প্রধান উপকরণ তালপাতা সংগ্রহ করতে হয় নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। আর পরিবারের প্রধান কর্তা এসব উপকরণ সংগ্রহ করে দেয়ার পরই বাড়ির নারী, পুরুষ ও শিশু কিশোর সকলে মিলে পাখা তৈরি করতে বসে পড়েন। এ অঞ্চলে ৭ তারী, ৯ তারী, ১১ তারী, ১৩ তারী ও ১৫ তারীর হাতপাখা তৈরি হয়। তবে এরমধ্যে ৯ এবং ১১ তারী হাতপাখাগুলো তালগাছের ডিগ পাতা দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি মজবুত ও টেকসই হওয়ার ফলে দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করা যায়।

তারা জানান, মাত্র ক’বছর আগেও হাতে গোনা টাকায় পাখা তৈরির উপকরণ পাওয়া যেত। তা এখন উচ্চমূল্যে কিনতে হয়। ইতোমধ্যে রংসহ অন্যান্য উপকরণের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুন তিনগুন হারে।

হাতপাখা তৈরির ইতিকথা : পাখাগ্রামে গিয়ে পাখাশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেকারত্ব থেকে রেহাই পেতে প্রায় শত বছর পূর্বে গ্রামের সাহাব মিয়া, বদর রহমান, আবুল বশরসহ আরো বেশ কয়েকজন যুবক জীবিকার সন্ধানে বের হন। পর্যায়ক্রমে তারা কুমিল্লা জেলার কোনো এলাকা থেকে রপ্ত করে আসে তালপাতার হাতপাখা তৈরির কলাকৌশল। আর তখনকার দিনে বিদ্যুৎ সুবিধার অপ্রতুলতার করণে দ্রুত প্রসার ঘটে এ গ্রামে তৈরি হাতপাখার। এ অঞ্চলে তৈরিকৃত রং বেরংয়ের হাতপাখা দেখতে সুন্দর ও অত্যন্ত মজবুত হওয়ায় ধীরে ধীরে সারাদেশে এর চাহিদা ও সুনাম গড়ে উঠে।

পাখাগ্রামের নারী, পুরুষ ও শিশু কিশোর নিজেরাই কারিগর আবার নিজেরাই মালিক। এ অঞ্চলে তৈরিকৃত হাতপাখা প্রতিজোড়া প্রকারভেদে ১শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। পুরো পাখাগ্রামে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার হাতপাখা তৈরি হয় বলে জানায় পাখাশিল্পীরা। সে হিসাবে গড়ে দৈনিক সাড়ে চার লাখ টাকার হাতপাখা তৈরি হয় এ গ্রামে। আর তৈরিকৃত এসব হাতপাখা নিয়ে বেকায়দায়ও পড়তে হয় না পাখাশিল্পীদের। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফাঁড়িয়ারা এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যায় অথবা অগ্রিম টাকা দিয়ে পরিমাণ মতো অর্ডার দিয়ে যায় পাখাশিল্পীদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্বৃত্তের হামলায় চুনতি অভয়ারণ্য বিট কর্মকর্তা আহত
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম দিন ৪০ শতাংশের বেশি অবিক্রিত