তারুণ্যের জয়গানে ঐকতান

নাসের রহমান | বুধবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৫ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

তরুণরা অনেক কিছু ভেঙে ফেলতে পারে। ভেঙে চুড়ে চুরমার করে দিতে পারে। পুরানো জঞ্জাল সরাতে পারে। জ্বরা জীর্ণকে নিঃশেষ করে দিতে পারে। পুরনোদের সরিয়ে নতুনদের জায়গা করে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা আশা জাগাতে পারে। স্বপ্ন দেখাতে পারে। মৌলিক অধিকারের স্বপ্ন। আসলে মৌলিক অধিকারের জন্য স্বপ্ন দেখতে হয় না। মৌলিক অধিকার ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষের মতো বাঁচতে হলে ন্যূনতম এ অধিকারটুকু থাকতে হয়। এ অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তাকে মানুষের মতো বাঁচা বলা যায় না। অন্য প্রাণীর মতো বেঁচে থাকতে হয়। যা মানুষের জন্য অবমাননাকর। এজন্য মানুষকে বাঁচার মতো বাঁচতে হয়। তরুণ বয়সে সবার মাঝে এরকম মনোভাব থাকে। সময়ের প্রবাহে নানা ঘাত প্রতিঘাতে তরুণেরা মনোভাবটা আর ধরে রাখতে পারে না। বেঁচে থাকার তাগিদ বড় হয়ে দেখা দেয়। অধিকার নিয়ে ভাবার সময় হয় না।

তরুণদের মধ্যে উদ্যম থাকে, আবেগ থাকে কিন্তু অভিজ্ঞতা থাকে না। তাদের শক্তি থাকে, সাহস থাকে। তারা যতো সহজে ভাঙতে পারে ততো সহজে গড়তে পারে না। নতুন করে গড়ে তুলতে হলে ধৈর্যের প্রয়োজন, অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, সামর্থেরও প্রয়োজন। একটি বহুতল ভবন কয়েক দিনে ভেঙে ফেলা যায় কিন্তু গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লাগে, দক্ষ জনবল লাগে। সুনিপুণ কারিগর লাগে। যেনতেনভাবে একটি ইমারত গড়লে তা টিকে থাকতে পারে না। যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। জান মালের ক্ষয় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। এজন্য যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করার আগে ভেবে চিন্তে সম্ভাব্য সকল দিক বিবেচনা করে নিতে হয়। আবেগ তাড়িত হয়ে শক্তি বা সাহসের জোরে কোন কিছু নির্মাণ করা যায় না, ভেঙে ফেলা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবেগের প্রয়োজন হলেও অনেক ক্ষেত্রে আবেগের বহিঃপ্রকাশ অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। এমনকি নস্যাৎ করেও দিতে পারে।

উদ্যম আর মনোবল থাকলে অনেক কিছু করা যায়। স্থবিরতাকে গতিশীল করা যায়। অচলকে সচল করা যায়। পুরানো মানসিকতাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্যমে চলা যায়। নিয়মকে ভেঙে ফেলে নতুন নিয়ম করা যায়। অব্যবস্থাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুস্থ ধারায় ফিরে আসা যায়। ঘুণে ধরা সমাজকে বদলে দেয়া যায়। এসব কথা বলা যতো সহজ করা ততো সহজ না। পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আইন কানুন নিয়ম নীতির ম্যারপেঁচে ঘুরপাক খেতে হয়। নানা রকম বাধা সরিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া যায় না। তরুণরা খেই হারিয়ে ফেলে। সঠিক পথের সন্ধান পায় না। বিভিন্ন ধরনের মতভেদ দেখা দেয়। তাদের অপরিপক্কতা কাল হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ ভ্রান্ত পথে অগ্রসর হতে চায়। মতবিরোধ আরো বেড়ে যায়। এতে করে উদ্যোম আর মনোবল আগের মতো থাকে না। এজন্য তরুণরা যে কোন কাজে অগ্রসর হলে সেখানে অভিজ্ঞ ও পরিপক্করে মতামত নিতে হয়। প্রয়োজনে তাদের সাথে নিয়ে এগিয়ে চলতে হয়।

কোনো কোনো আন্দোলন সংগ্রামে তরুণরা মূল শক্তি হিসাবে কাজ করে। বিগত সরকার পতনের আন্দোলনের মূল শক্তি ছাত্র তরুণরা। দেশের অধিকাংশ ছাত্র এ আন্দোলনে রাস্তায় নেমে আসে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষমতাধর একটি সরকারের পতন ঘটে। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষগুলো দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও এটি করতে পারে নি। ছাত্র তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে শক্তি অর্জন করেছিল তা বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের কখনো ছিল না। তবে ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে রাজনৈতিক শক্তি যুক্ত হওয়ায় সরকার পতনের ঘটনা ত্বরান্বিত হয়। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। যেখানে ছাত্রদেরও প্রতিনিধিত্ব অর্ন্তভুক্ত করা হয়। বিগত সরকার পতনের পর ছাত্রদের সুর্নিদিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকায় তারা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেনি। একেক সময়ে একেক ধরনের মতামত বা মন্তব্য এসেছে ছাত্রদের কাছ থেকে। যা কখনো কখনো জনআকাঙ্ক্ষার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। যাতে ছাত্রদের ঐক্যমতেরও প্রতিফলন ঘটে না। আন্দোলনের সময় যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে তা ধরে রাখা প্রয়োজন। ধরে রাখতে না পারলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

তারুণ্য দিয়ে অনেক কিছু জয় করা যায়। জয় করা গেলে শেষ হয়ে যায় না। নতুন করে শুরু হয়। বিজয়কে ধরে রাখতে হয়। যারা জয় করে তারা অনেক সময় ধরে রাখতে পারে না। ধরে রাখতে অবলম্বন লাগে। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হয়। দেশ বদলানো যায়। মানুষ বদলানো যায় না। সংস্কৃতি বদলানো যায় না। সংস্কৃতি নিজস্ব ধারায় চলে। শাসন ব্যবস্থাও সহজে বদলানো যায় না। শাসন ব্যবস্থা বদলাতে হলে মানুষ লাগে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ। এ মানুষদের আগে তৈরি হতে হয়। এটা সহজ কোনো ব্যাপার না। এর জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া শাসন ব্যবস্থা চালানো যায় না। তরুণদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে এরাই নতুন সমাজ বিনির্মাণ করতে পারবে। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন, অভিজ্ঞজনদের মতামতের প্রয়োজন। ইতিহাসের শিক্ষার প্রয়োজন। দেশ ও জাতির অতীত গৌরবকে ধারণ করা প্রয়োজন। জাতির গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগকে সম্মান দেখানো প্রয়োজন। অতীতের মহান অর্জনকে বিসর্জন দেয়া যায় না। অতীত ইতিহাসকে ধ্বংস করা যায় না। এরকম কিছু করতে গেলে নিজেদের অস্থিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে একসময়। জাতি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার সকল সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। তখন আর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য তরুণদের যে কোনো পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত ভেবে চিন্তে সবদিক বিবেচনা করে নেয়া প্রয়োজন। যার উপর নির্ভর করবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণ।

লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ