তারুণ্যের আদর্শ ডা. এল এ কাদেরী স্মরণে

সনিয়া কাদেরী | বৃহস্পতিবার , ২৯ আগস্ট, ২০২৪ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

দেখতে দেখতে তিনটি বছর পেরিয়ে গেল আমার প্রাণাধিক বাবা পার্থিব জগতের মায়া কাটিয়ে ছেড়ে গিয়েছেন। সেই শোক কাটিয়ে ওঠার আগে হারালাম পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন আমার মাকে গত ৫ মে। মাবাবা দুজনেই দৈনিক আজাদীর একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। মা কোনো উল্লেখযোগ্য বা মনকাড়ার মতন চমকপ্রদ লেখা পড়লে আমাকে ফোনে বলতেন অনলাইনে লেখাটা পড়ার জন্য। বিশেষ করে ২৯ আগস্ট বাবার প্রয়াণ দিবসের আগে জিজ্ঞেস করতেন তাঁকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভাবছি কিনা। গত দুই বছর মূলত মায়ের অনুপ্রেরণায় বাবাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা আজাদী সমীপে পাঠানোর তাগিদ অনুভব করেছি, কারণ মা ছাপার অক্ষরে লেখাটি দেখলে যে পরিমাণ আনন্দিত হয়ে আদরমাখা কন্ঠে আমাকে প্রশংসা করতেন তা শোনার জন্যই যেন লেখালেখির উৎসাহ পেতাম। তাই আজ মায়ের অনুপস্থিতি নিদারুণভাবে হৃদয় গহীনে হাহাকার হয়ে উঠে। এ অবস্থায় শোকাচ্ছন্ন বিক্ষিপ্ত মনকে বশ মানিয়ে কিছু লিখতে যাওয়াটা দুষ্কর। আশঙ্কা করছিলাম এবার হয়তো বাবাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত যে ভাবনাগুলো মনকে আন্দোলিত করে, তা হয়তো অব্যক্তই রয়ে যাবে মনের গহীনে।

কিন্তু আজকের এই পরিবর্তিত আঙ্গিকে মনে হলো সময়ের প্রয়োজনে অবশ্যই বাবাকে নিয়ে দুটি কথা বলা আমার দায়িত্ব, কারণ জুলাইয়ের প্রথমে দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি থেকে শুরু করে আজ অব্দি শুধু প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে বাবামা এই সময়ের সাক্ষী হতে পারলে কেমন বোধ করতেন। তাঁরা দুজনই আমার দেখা সেরা এবং নিখাদ দেশপ্রেমিক, দেশের মানুষের মঙ্গলে শেষ পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। বাবাকে দেখেছি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। রাজনৈতিক কোনো গোত্রের নৈকট্য বা পৃষ্ঠপোষকতার তোয়াক্কা না করে নিজের কর্মক্ষেত্রে একাগ্রতা, মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে চট্টগ্রাম তথা পুরো বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ছিলেন এবং থাকবেন আগামী প্রজন্মের কাছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে ভাবছিলাম ছাত্রছাত্রীদের মেধা ভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করার যে সময়োপযোগী অধিকার তা বাবাকে কি সুন্দর এবং যৌক্তিকভাবে প্রয়োগ করতে দেখেছি সবসময়। বাবা সবচেয়ে খুশী হতেন যখন দেখতেন হয়তো আর্থিকভাবে অসচ্ছল গ্রামাঞ্চলের কোনো ছাত্রছাত্রী নিজ মেধার জোরে সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেতো। বাবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন যাতে সব ছাত্রছাত্রীরা নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। শুধু তাই নয় তাদের উদাহরণ দিতেন সবসময়, যাতে অন্যান্যরাও নিজেদের সর্বোচ্চ যোগ্যতা দিয়ে সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। বাবার চিন্তাধারার সাথে এই বৈষম্যবিরোধী ন্যায়ভিত্তিক দেশ ও সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। বাবা নিশ্চয়ই আজকের ছাত্রসমাজের এই সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং তাদের অর্জন দেখে যেতে পারলে অনেক গর্ব বোধ করতেন তা আমি অনুমান করতে পারি।

তদুপরি নিজের এলাকা হাটহাজারী থেকে শুরু করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র বাবার কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব এবং সর্বোচ্চ প্রাধান্য পেয়েছে। আজ হাটহাজারীর কৃতী সন্তান প্রফেসর ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেখে যেতে পারলে বাবামা অনেক উচ্ছ্বসিত হতেন। চট্টগ্রাম থেকে মনোনীত অন্যান্য উপদেষ্টা মণ্ডলীর জন্য বাবা নিশ্চয়ই অনেক গর্ববোধ করতেন। মনে মনে তাই কল্পনা করি বাবা কীভাবে তাঁর আনন্দ আমাদের সাথে ভাগাভাগি করতেনআজ তাঁর অনুপস্থিতি গভীরভাবে অনুভূত হয়।

ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে বাবার বিষয়ে আরেকটি তথ্য না জানালে নয়। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিএমএ, চট্টগ্রামের সভাপতি হিসেবে সমগ্র চিকিৎসক সমাজের নেতৃত্বে ছিলেন বাবা। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি, আমরা ভীষণ আতঙ্কে থাকতাম, যখন বাবা আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে রাজপথের সম্মুখ আন্দোলনে সামিল হতেন। শুধুমাত্র সৎ সাহসই যে সফল আন্দোলনের বীজমন্ত্র তা যেমন তাঁকে দেখে বুঝেছি, আমি আবার অবাক বিস্ময় নিয়ে অবলোকন করলাম আজকের দুর্বার জেনজিদের মাঝেও।

বাবা ব্যথিত এবং বিব্রত হতেন প্রশাসনে বিভিন্ন দুর্নীতি এবং দলীয়করণ দেখলে। আজকের এই আন্দোলনের পরিণতি নিশ্চয়ই বাবা এবং তাঁর প্রজন্মের অনেক সৎ দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত এক ফসল। নিউরোসার্জারিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চট্টগ্রামের বুকে বাবা ফিরে এসেছিলেন দুচোখে দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মানুষের সেবা করে গিয়েছেন। তাঁর নাতিনাতনীদের প্রতিবছর নিজের দেশে নিজের গ্রামে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন শেকড়ের গভীরতা কী তার বাস্তব অভিজ্ঞতা দেয়ার জন্য। নিজের মাটির দুর্নিবার টান কখনই অগ্রাহ্য করতে পারি না বহু বছর বিদেশে থাকা সত্ত্বেও। আমার দুই ছেলেমেয়ে দেশের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে স্বতস্ফুর্তভাবে প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশের পতাকা তুলে।

সবশেষে এটুকু বলবো, যে মহান আদর্শ ধারণ করে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশ গঠনে শ্রম, মেধা আর নিষ্ঠা দিয়ে যেভাবে বাবা নিরলস কাজ করে গিয়েছেন তা আজকে আন্দোলনের অর্জিত এই নতুন প্রেক্ষাপটে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন করে। আমার গভীর বিশ্বাস বাবা চির আদর্শনীয় এক অনুপ্রেরণা যোগাবেন নতুন প্রজন্মের কাছে। বাবার স্মৃতি সমুজ্জ্বল হয়ে থাকুক তাঁর প্রিয় পরিজন, অসংখ্য চিকিৎসক ছাত্রছাত্রী এবং চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়েসন্তান হিসেবে এই প্রত্যাশা করতে পারি।

লেখক : ডা. এল এ কাদেরীর কন্যা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত তড়িৎ প্রকৌশল বিজ্ঞানী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমার জন্য
পরবর্তী নিবন্ধবেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন জরুরি