কক্সবাজারের টেকনাফে কোস্টগার্ড ও র্যাবের যৌথ অভিযানে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবা, ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল ও ক্রিস্টাল মেথ জব্দ করা হয়েছে। গত বুধবার দুপুরে কোস্টগার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন–অর–রশীদ এ তথ্য জানান। তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাত ২টা ৩০ মিনিটে কোস্টগার্ড ও র্যাব মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে হ্যাচারি সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় ডগ স্কোয়াডের সাহায্যে জঙ্গল থেকে একটি বস্তা জব্দ করা হয়। পরবর্তীতে বস্তাটি তল্লাশি করে ১ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা, এক কেজি সম্ভাব্য ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল (পাউডার) ও এক কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস) পাওয়া যায়।
মাদক সমস্যা তথা মাদক দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার ও অবৈধ পাচার একটি জটিল, বহুমাত্রিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও চোরাচালান সমস্যা দেশ–কাল, ধর্ম–বর্ণ, সমাজ নির্বিশেষে আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করছে। ধনী–দরিদ্র, উন্নত–উন্নয়নশীল কোন দেশই মাদক সন্ত্রাস থেকে মুক্ত নয়। মাদককে ঘিরে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, সংঘাত–দ্বন্দ্ব, কলহ, দুর্ঘটনা, ধ্বংস ও মৃত্যুর যে খেলা চলছে তাকে নিবারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তি আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন যথা– স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তাই মাদক ব্যবসায়ী, মাদক বহনকারী ও মাদকসেবী–সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। ইয়াবার মতো মাদক মানুষকে ধ্বংস করছে, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ককে নষ্ট করছে।
আইনজীবীসহ অনেকের অভিযোগ, পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানেন, মাদক ব্যবসা কাদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাদের ধরা হয় না। ধরা পড়ে চুনোপুঁটি, যারা পরিবহন বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে। এছাড়া আদালতে বিচারের মাধ্যমে অপরাধী প্রমাণিত না হলে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক যেভাবে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, তাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এর কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মাদক পেলে মাদকসেবীর শাস্তি হতে পারে। তবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সচেতন মানুষ আশা করছে, এখন যেহেতু নতুন আইন হয়েছে, মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশে মাদক ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে নানা সময় অভিযান পরিচালনার পরও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ছে প্রচুর মাদকদ্রব্য। পত্রিকায় প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এর মধ্যে ৪০ লাখই তরুণ। তিনভাবে মাদক প্রতিরোধ কার্যক্রম চলছে। একটি অপারেশনাল, যার মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের গ্রেফতার করে কোর্টে জমা দেওয়া হয়। আরেকটি হলো উদ্বুদ্ধকরণ, যার মাধ্যমে মাদকবিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে চিকিৎসা, যার মাধ্যমে মাদকের বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি জেলায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থাকা উচিত। সরকারি কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ৪০ বেড থেকে ৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে এটি ২৫০ বেডে উন্নীত করার কাজ চলছে। মাদকাসক্ত এই জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মাদকের অবাধ বিস্তার রোধে মাদকবিরোধী আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি মাদক নিরোধ–শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার উপর জোর দেন সরকার। তাই মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং অবৈধ পাচার রোধে সোচ্চার হতে হবে। মাদকাসক্তির কারণে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটা অংশের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে। পারিবারিক অশান্তি ও সহিংসতা বৃদ্ধির একটা বড় কারণ মাদকাসক্তির বৃদ্ধি। তাই দেশে এখন মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক ও আইনি যুদ্ধ প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। মাদকের আগ্রাসন থেকে দেশ, সমাজ ও তারুণ্যকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে মাদক বিরোধী কর্মসূচি প্রণয়ন করা যেতে পারে।