তারায় তারায় ভরা আকাশে স্মৃতির নষ্টালজিক জ্যোতি

এষা খাস্তগীর | সোমবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৭:২০ পূর্বাহ্ণ

বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের শুরুর দিকে কোনো এক সকালে অবুজসবুজ ও কচিকাঁচা বয়সের এক শিশু পরিবারের সাথে জন্মভিটা ছেড়ে সাম্পানে চঙে কর্ণফুলীর এপারে শহরে পা রেখেছিলো। শিশুটি অবাক চোখে চারদিকে তাকায়, এই অচেনা ও অজানা পরিবেশেই তাকে থাকতে হবে পরিবারের সাথে। সম্ভ্রান্ত ও রক্ষণশীল পরিবারের বড়কর্তা শিশুটির সৌম্যদর্শন পিতা সপরিবারে চন্দনপুরায় যে বাড়িটিতে উঠলেন সেটা শহরের এক প্রান্তে চন্দনপুরায় জনবিরল একটি উঁচু টিলার ঢালে। আশেপাশে উঁচু দালানকোটা না থাকায় টিলার গায়ে খাঁড়া বাড়িটি শহরের অনেক দূর থেকে দেখা যায়। এটাকে সে সময় শহরের অন্যতম ‘পশ’ বাড়ি বলা হতো। শিশুটির পিতার পরমপ্রিয় বন্ধু ও সুহৃদ আনোয়ারার বনেদী জমিদার প্রসন্ন কুমার রায় শহরের বিশালভূমিসহ এই বসত বাড়িটি তদানীন্তন মহালক্ষ্মী ব্যাংকের নিলাম থেকে খরিদাসূত্রে কেনা। লাল ইটের সুদৃশ্য বাড়িটির আঙ্গিনা বেশ বড়সড়। মূল ভবনের সামনে বড় মাঠ, পাশে স্বচ্ছ জল ভরা পুকুর, ফুলেফলে ভরা সবুজ গাছগাছালী, পাখপাখালীর কলকাকলীতে মুখরিত আঙ্গিনার এখানে সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ ঝোপঝাড় বেশ মনোলোভা, যেনবা শহরের ভেতরেই ফেলে আসা জন্মভিটার একখণ্ড খোলামেলা গ্রামীণ পট। এখানেই সৃজিত শিশুটি ও তার পরিবারের ‘এই শহরে আবাসগাঁথা’। এই নামেই সেদিনের ঐ শিশুটি এখন সত্তরোর্ধ প্রাজ্ঞমনষ্কঋদ্ধ পরিপূর্ণ মানুষ ওসমান গণি মনসুর লিখেছেন সেই শৈশব থেকে বর্ণিল রূপময় বৈচিত্র্যে, কোমলকাঠিন্যে, আনন্দবেদনাবিরহহর্ষে আজতক নিজের বেড়ে ওঠার গল্পকথা।

অতি সম্প্রতি বলাকা প্রকাশন চট্টগ্রাম থেকে গ্রন্থাকারের প্রকাশিত ওসমান গণি মনসুরের এই গল্পকথা কি শুধুমাত্র সহজসরল আপন ভুবনের কথামালা! না, মোটেই তা নয়। ওসমান গণি মনসুর এই গ্রন্থের পূর্বকথায় লিখেছেন, ‘জীবন কথা সাজানো, ফেলে আসা ঘটনাকালের জীবনের চেয়ে অনেক কঠিন। সব অসম্ভব হয়তো সম্ভব করা যায়, নতুন করে রঙিন করা যায়। যায় না কেবল ঘটে যাওয়া ঘটনায় ফিরে যাওয়া।’

কিন্তু ফিরে না গেলেও তো কোনো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তিও তো ঘটে। অর্থাৎ যে ঘটনা একবার ঘটে গেছে তা তো অতীত, যদি পুনর্বার ঘটে সেটা পুনরাবৃত্তি। ইতিহাসে এমনতরো পুনরাবৃত্তির ঘটনা মোটেও বিরল নয়, বরং পুনরাবৃত্তির একাধিক নজীর আছে। এমন পুনরাবৃত্তির নজীর লেখকের ব্যক্তি জীবনেও আছে। যেমন অকালে হারানো আত্মজ ‘রাফিকে’ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্ত্রীর গর্ভজাত হয়ে ‘ফিরা’ নামে প্রাপ্তিযোগের ঘটনা। ‘রাফি’ শব্দটি উল্টো করলে ‘ফিরা’ হয়। এভাবেই তো বিষাদের আদি ঘটনার বর্তমানের ‘হর্ষ’ হয়ে পুনরাবৃত্তি ঘটে গেলো ওসমান গণি মনসুরের ব্যক্তিজীবনে।

আসলেই অনেক ক্ষেত্রেই বড়মাপের মানুষের জীবন ইতিহাসের পরিপূরক, কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তা না হলেও পৃথিবীর বহু বড় বড় ঘটনায় একজন সাধারণ মানুষের বীরত্বগাথাও ইতিহাসের অংশ হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাধারণ প্রান্তজনও অসাধারণ ভূমিকা রেখে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছেন। ওসমান গণি মনসুর প্রণীত এই গ্রন্থে এমন কিছু স্মৃতির মানুষকে বিস্মৃতির অতল থেকে উদ্ধার করেছেন। তারা অনেক আগেই বিগত হলেও আকাশের তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে আছেন। অর্থাৎ তাঁর গল্পকথার কোনো কোনো চরিত্র সময়ের বিবর্তনে এখনও জীবন্ত।

ওসমান গণি মনসুর মূলত সাংবাদিক। তিনি চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পর প্রথম প্রজন্মের সাংবাদিক হিসেবে আজতক যে কজন বেঁচে আছেন তাঁদের মধ্যে তিনিই আমার জানামতে একজনই এখনও স্বপেশায় সক্রিয়ও নিবেদিত হয়ে একটি ইংরেজী দৈনিকের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সাংবাদিকতায় কবেই তো তিনি অর্ধশতাব্দীকাল অতিক্রম করে গেছেন। সাংবাদিকতায় অতদূর থেকে এ পর্যন্ত পৌঁছানোর দীর্ঘ পথরেখায় ইতিহাসের অনেক উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেমন আছে কিংবদন্তীতূল্য রাজনৈতিক, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাথে আলাপ ও সান্নিধ্য সঙ্গের স্মৃতিকথা। এগুলো এই গ্রন্থের টুকরো টুকরো হিরকখণ্ড। পাঠকরা যদি এগুলো কুড়িয়ে নিতে পারেন তা হলেই ওসমান গণি মনসুর সার্থক।

তিনি পূর্বকথায় লিখেছেন, ‘আমার এই বায়োগ্রাফি বা স্মৃতিকথা আমাদের কালের ইতিহাসের কিঞ্চিত উপাদানের সহায়ক হলে; বা মানসকল্প চিত্রিত হলেতা হবে জীবদ্দশায় ইতিহাসে আমার সর্বোত্তম ব্যক্তি অবদান।’ মনসুর এটাই বলতে চেয়েছেন যে, জীবনের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়গুলোর চুম্বক অংশগুলোও কখনো কখনো ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে পারেযদিওবা প্রতিদিন ও ক্ষণের লিপিমালা সুলিখিত নাও হয়।

এই শহরে আবাস গাথা’ গ্রন্থের ১১টি এপিসোডের প্রথমটি আমার আমি’তে ওসমান গণি মনসুর নিজের জীবন সঙ্গীতের রাগাশ্রয়ী ‘আলাপ’এ বিস্তার সাধন করেছেন। এতটুকু বিস্তারে যতটুকু সুখ, ততটুকু কষ্টকল্পিতও।

এই গ্রন্থে অন্য এপিসোডগুলো হলোদ্রুত বদলাচ্ছে শহুরে জীবনধারা, সাংবাদিকতায় অর্ধশতাব্দীর বিচ্ছুরণ, আমি দেখেছি এক অভিমানী বঙ্গবন্ধুকে, উড়িরচরের আইলে তিন রাষ্ট্রপ্রধান, ভয়াল ঝড় ’৯১ ফেরেশতা থেকে সি অ্যাঞ্জেলস, ’৯১ এর আর্তি খোদা, কেন এমন হলো, এক ইতিহাসঐতিহ্যের করুণ অন্তর্ধান!, ফায়ার ব্রিগেডের ঘণ্টা এবং বিচিত্র ঘণ্টাকথা, মিথ্যার চেয়ে মৃত্যু ভালো এবং প্রণয়, পরিণয় এবং প্রলয়ের পর।

ওসমান গণি মনসুর একদা লেখক হয়ে উঠবেনএমন কোন প্রস্তুতি তাঁর ছিলো না। তবে সাংবাদিক হিসেবে তাঁরা অনুসন্ধিৎসুপ্রবণ মন তাঁকে সৃজনশীল হতে প্রাণিত করেছে। এই গ্রন্থে তাঁর সৃজিত এপিসোডগুলোতে তাঁর সৃজনশীল লেখকসত্তাটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সমাজ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সচেতন ওসমান গণি মনসুর ঘটমান বাস্তবতার নানান টানাপোড়নের মধ্যেও নির্লিপ্ত ও নির্ধিকার থাকতে চান না এবং যতই প্রিয় বা অপ্রিয় হোক জীবন সত্যকে আড়াল করতে চান নাহয়তো বা এই তাগিদ থেকেই তিনি লিখে চলেছেন। ‘এই শহরে আবাসগাথা’, ওসমান গণি মনসুর, বলাকা প্রকাশন, চট্টগ্রাম, দাম৩০০ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত সন্দ্বীপ
পরবর্তী নিবন্ধসন্তানের বেড়ে ওঠা ও চরিত্র গঠনে সমবয়সীদের ভূমিকা