তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮–১৯৭১)। কথাসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ। প্রথম জীবনে কিছু কবিতা লিখলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবেই তারাশঙ্করের প্রধান খ্যাতি। শরৎচন্দ্রের পরে কথাসাহিত্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তারাশঙ্কর ছিলেন তাঁদের একজন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ই জুলাই বীরভুমের লাভপুর গ্রামে। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বগ্রামের যাদবলাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক আদর্শ, বিশেষ করে অসহযোগ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। সেই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এক বছর অন্তরীণ থাকেন। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের এখানেই সমাপ্তি ঘটে। সমাজ সেবার লক্ষ্যে তিনি জড়িয়ে পড়েন কংগ্রেসের রাজনীতিতে। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ–এর সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর সকল রচনারই প্রধান অনুষঙ্গ জীবন প্রত্যয়, মানুষের মহত্ব ও মানব জীবনের প্রতিষ্ঠা। সমাজের রূপ–রূপান্তর ও মানুষের শ্রেণিগত বিবর্তন, এসবের প্রতিক্রিয়া তাঁর সাহিত্যের বৈভব। ব্যক্তিজীবনের নানামুখী অভিজ্ঞতা তারাশঙ্করের রচনায় এনেছে বৈচিত্র্য। মাটি ও মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন অকৃপণভাবে। তারাশঙ্কর প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে : ‘রাইকমল’, ‘কবি’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, ‘মন্বন্তর’, ‘হারানো সুর’, ‘সন্দীপন পাঠশালা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘কীর্তিহাটের কড়চা’, ‘অরণ্য–বহ্নি’, ‘সপ্তপদী’, ‘অভিযান’ প্রভৃতি। তাঁর বেশ কিছু কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর কালজয়ী এই সাহিত্যিক প্রয়াত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ সময় তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গঠিত ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবী সমিতি’র সভাপতি ছিলেন আমৃত্যু। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শরৎস্মৃতি পুরস্কার’ (১৯৪৭) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৬) লাভ করেন। এছাড়া তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৫৫), ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ (১৯৫৬), ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ (১৯৬৭) এবং ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৬২) ও ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।