চট্টগ্রামের কাজীর দেউড়ির খান বাড়িটি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আর আট–দশটি বাড়ির মত নয়। তাদের কাছে এই বাড়ির রয়েছে আলাদা একটি মাহাত্ম্য। কারণ এই বাড়ি থেকে যে এসেছে একের পর এক জাতীয় দলের ক্রিকেটার। শুধু জাতীয় দলের ক্রিকেটার বললে ভুল হবে। জাতীয় দলের দুই অধিনায়কই এসেছেন এই বাড়ি থেকে। অনূর্ধ্ব–১৯ দলের অধিনায়কও ছিলেন এই বাড়ির একজন। এই খান বাড়ির আরও বিশেষত্ব এই পরিবারের মত আরেকটি ক্রীড়া পরিবার বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যে পরিবারের সব সদস্যই ফুটবল এবং ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত।
তবে এই খান বাড়ির প্রবাদ পুরুষ ছিলেন যিনি তিনি হলেন ইকবাল খান। দুই জাতীয় দলের ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল এবং তামিম ইকবালের পিতা। এই দুই সহোদরের মধ্যে পরের জনই বোধহয় এই খান বাড়িকে সবচাইতে বেশি পরিচিত করেছে দেশে এবং বিদেশে। এর পরে যিনি রয়েছেন তিনি আকরাম খান। বাংলাদেশ দলের আইসিসি ট্রফি জয়ী অধিনায়ক। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে আকরাম খান অতিমানবীয় ৬৭ রানের ইনিংসটি না খেললে হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেট এত তাড়াতাড়ি আজকের জায়গায় আসতে পারতো না। সেই ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি জেতার দিন থেকেই খান বাড়িতে শুরু আনন্দের উৎসব। সেদিনের সেই রঙিন দিনগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে।
এরপর আইসিসি ট্রফিতে যখন চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ তখন আবারো চট্টগ্রামের মানুষ রঙিন করে তোলে খান বাড়িকে। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের যেন শেষ ছিল না। এরপর নাফিস–তামিমরা যখন ক্রিকেটে এলেন তখন আবারো রঙিন হলো খান বাড়ি। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার আরো একবার চট্টগ্রামের মানুষ ভিড় করেছিল খান বাড়ির সামনে। তবে সেটি ছিল বেদনা আর বিষাদের ভিড়। সে ভিড়ে ছিল না কোনো উচ্ছ্বাস। কারণ খান বাড়ির ছোট ছেলে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক একেবারে হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষকে। তারপরও মানুষ ভিড় করেছিল খান বাড়ির সামনে। কিন্তু তাদের মন ভালো ছিল না। মুখে ছিল না হাসি। চোখে ছিল বেদনার জল। এ যেন আপনজন হারানোর চাইতেও বেশি বেদনা। খান বাড়ির ছোট নবাব দেশের হয়ে খেলবে না সেটা মেনে নেওয়া যেন ছিল কষ্টের। অনেকটা প্রিয়জন হারানোর মত বেদনায় ব্যথাতুর মানুষগুলো ঘরে ফিরেছিল কষ্টের পাথর বুকে চেপে।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা। দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় চট্টগ্রামের মানুষ রাগে, ক্ষোভে ফুসেছে। করেছে মানববন্ধন। আকুতি জানিয়ে বলেছে– তামিম ফিরে এসো। অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যায় আবারো উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে উঠল কাজীর দেউড়ির খান বাড়ি। কারণ গতকাল সন্ধ্যায় তামিম ইকবাল যখন প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন থেকে বেরিয়ে বললেন আমি আবার ফিরে এসেছি ক্রিকেটে। আবার খেলব বাংলাদেশের জার্সি গায়ে। আবার কাঁধে তুলে নেব অধিনায়কের দায়িত্ব। তখন চট্টগ্রামের মানুষের আনন্দ আর দেখে কে? আগের দিনের কষ্টের পাথরটা বুকের উপর থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সবাই ছুটলেন সেই খান বাড়ির দিকে। যেখানে কেটেছে তামিমের শৈশব। যেখানে বেড়ে উঠেছেন খান বাড়ির ছোট নবাব। বাড়ির সমানে কয়েক পা দূরত্বে আউটার স্টেডিয়ামে তামিম পেয়েছিলেন ক্রিকেটের হাতেখড়ি। তবে সে ইতিহাস যেন তুচ্ছ ক্রিকেট পাগল মানুষের কাছে। তাদের কাছে সবচাইতে বড় পাওয়া তাদের ছোট নবাব আবার ফিরেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। তাই উৎসবের রঙে যেন ভাসছিল খান বাড়ি।
তামিম ঢাকায়। নাফিস বাংলাদেশ দলের সাথে হোটেলে। আকরাম খান দেশের বাইরে। তাই বলে কি আনন্দ আয়োজন বন্ধ থাকবে? খান বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারা শামিল হলেন ক্রিকেট পাগল মানুষের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে। তাদের একটাই কথা তামিমকে ছাড়া তারা বাংলাদেশের ক্রিকেট কল্পনা করতে পারে না। মিষ্টি বিতরণ করে, কোমল পানীয় খাইয়ে খান বাড়ির নতুন প্রজন্ম আনন্দ ভাগাভাগি করল তামিম ভক্তদের সঙ্গে। অথচ এই প্রজন্ম দেখেনি সেই আইসিসি ট্রফি জয়ী উৎসবের আবহ। পরিবারের কাছে যেমন তামিমের ফেরাতে আনন্দের শেষ নেই তেমনি ক্রিকেট পাগল চট্টগ্রামের মানুষের মাঝেও এই আনন্দ যেন বলে বুঝানোর মত না। এখন তাদের একটাই চাওয়া সামনের দুটি বড় ইভেন্ট এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপে তামিমের নেতৃত্বেই যেন বাংলাদেশ সোনালী সাফল্য লাভ করে।