তীব্র তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস দশা এখন পাহাড়ের মানুষের। ঘন জঙ্গল ও গাছ–গাছালি বেষ্টিত পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতেই পূর্বের সময়ের চেয়ে বর্তমানে তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পাহাড়ে এখন তাপপ্রবাহ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, অবকাঠামো স্থাপনসহ নানান সঙ্গত কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে ক্রমাগত তাপপ্রবাহ বাড়ছে পাহাড়ে। বিগত কয়েকদিনের তীব্র রোদ ও তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষ। জীবিকার তাগিদে প্রত্যহ কাজে বের হওয়া প্রান্তিক মানুষদের তীব্র রোদে পুড়ে কাজ করতে হচ্ছে।
এদিকে, রাঙামাটিতে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদাও। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের যোগান না পাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে বিপিডিবির বিতরণ বিভাগকে। চাহিদার প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে পারায় জেলা শহরেই দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। জেলার উপজেলাগুলোতে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও বেশি। রাঙামাটি জেলা শহরের সবচেয়ে শ্রমঘন এলাকা হিসেবে পরিচিত সমতাঘাট। গতকাল বুধবার সাপ্তাহিক হাঁটবারের দিনে বনরূপা হাঁটে আসা ক্রেতা–বিক্রেতা তীব্র রোদে দুর্ভোগে পড়েছেন। অন্যদিকে কাপ্তাই হ্রদ বয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে সমতাঘাটে বিভিন্ন কৃষি পণ্য ও ফল নিয়ে আসা কৃষকদের মাঝেও দেখা গেছে গরমে ত্রাহি দশা।
সমতাঘাটের কয়েকজন শ্রমিক জানালেন, শীত–গ্রীষ্ম–বর্ষা কোনো ঋতুতেই তাদের বসে থাকার সুযোগ নেই। তীব্র রোদে পুড়ে–বৃষ্টিতে ভিজে তাদের পণ্য উঠানামার কাজ করতে হচ্ছে। অনেকেই এখন তীব্র রোদে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসেও বর্তমান তাপমাত্রাকে অস্বাস্থ্যকর বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস সম্পর্কিত ইন্টারনেট সাইট অ্যাকুওয়েদারের পর্যবেক্ষণ বলছে, বুধবার রাঙামাটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে আজ বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। আজকের (বৃহস্পতিবার) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি এবং সর্বনিম্ন ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। পাশাপাশি জেলার কয়েকটি জায়গায় বজ্রপাতসহ ঝড়ের আশঙ্কাও করা হচ্ছে। পূর্বাভাসে আরও জানা গেল, আগামীকাল শুক্রবার ৩৬ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নামলেও শনিবার ৩৭ ডিগ্রি থাকবে। শুক্র ও শনিবারে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকবে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা সদরের বাসিন্দা উৎস দেবনাথ বলেন, এ বছর নানিয়ারচরে ব্যাপক গরম পড়বে। শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার কারণে হাটবারে বাজারে আসলে পাহাড়ি গ্রামের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েন। গ্রীষ্মের তীব্র খরায় বেশি ভুগছেন উপজেলার পাহাড়ি এলাকার মানুষ। বেশিরভাগ গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় গরম থেকে পরিত্রাণ পেতে বৈদ্যুতিক কোনো সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন না তারা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) রাঙামাটি বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দীন জানান, রাঙামাটি গ্রিডের বিদ্যুৎ চাহিদা রয়েছে ১৬ মেগাওয়াট; তবে নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে ৭–৮ মেগাওয়াট। তবে মাঝেমধ্যে ৮–১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া গেলে লোডশেডিং কম হয়। রাঙামাটি গ্রিড থেকে মূলত কাউখালী, রাঙামাটি সদর ও মহালছড়ি–নানিয়ারচরের কিছু অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়। তবে বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও বরকলের বিদ্যুৎ সরবরাহ দেয়া হয় চন্দ্রঘোনা গ্রিড থেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক ড. সুপ্রিয় চাকমা আজাদীকে বলেন, পাহাড়ে তাপমাত্রা বাড়বে এটা তো এখন স্বাভাবিক বিষয়। আগের মতো ঘন গাছপালা এখন আর নেই। গ্রামে–গ্রামে ছনের ঘরের বদলে এখন টিনের ছাউনির ঘরবাড়ি বেড়েছে। এখন আর বছরজুড়ে পাহাড়ের ঝিরি–ঝরনাগুলোতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, গাছপালা কমে যাওয়া ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের প্রভাবে পাহাড়ে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।