সমাজের একটি বৃহৎ অংশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯–১৬ শতাংশের মতো জনগোষ্ঠী প্রতিবন্ধী, সে হিসাবে এর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। তাদের বাদ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়; কিন্তু স্বচ্ছন্দ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা ব্যতীত উন্নয়নের যাত্রাপথে তারা শুধু বাধাপ্রাপ্তই হবে। তাঁদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভাতানির্ভর না রেখে তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে সৃজনশীল উদ্যোগ নিতে হবে। প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, অবকাঠামোগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব গড়ে তুলতে হবে। জীবনের কোনো একটি পর্যায়ে সে যদি আশ্রয়হীন হয়ে যায় তাহলে আমাদের এত আয়োজন, এত কর্মসূচি, জীবন মানোন্নয়নের এত প্রচেষ্টা সবকিছুই ভেস্তে যাবে।
আমরা জানি, বাংলাদেশের জাতিসংঘের প্রতিবন্ধিতা সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষর করেছে অনেক আগে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সনদের ২৭ নম্বর আর্টিকেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের কথা বলা আছে। সেই সঙ্গে তাঁদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টির কথাও বলা আছে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ সালের কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি সংস্থান ও চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের কথা খুব জোর দিয়ে বলা হয়েছে। সুতরাং আমাদের দেশের আইন প্রতিবন্ধীদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক।
বিশেষজ্ঞরা তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে বলেন, কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পিছিয়ে আছেন, নাকি আমরাই তাঁদের পিছিয়ে রাখছি, সেটাও ভাবতে হবে। শুধু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধরেও রাখতে হবে। তাঁরা যাতে ঝরে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষের নিয়োগ পাওয়া যেমন জরুরি, তেমনি কর্মপরিবেশ ভালো রাখাটাও জরুরি। তাঁরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে আবার ঝরে পড়বেন। প্রয়োজনে তাঁদের সহায়তা দেওয়া দরকার। কোথাও দেখা যায়নি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তাঁরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। তাঁরা বরং আরও আগ্রহ নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের পাশে আমাদের সবার দাঁড়াতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমাদের আরও বেশি উদার হওয়া দরকার। প্রচার–প্রচারণা আরও বাড়ানো দরকার।
সমাজে প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান, এটি দূর করার জন্য গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে সমাজ থেকে ভ্রান্ত ধারণা দূর করা সম্ভব। জাতিসংঘ ঘোষিত সনদ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল বাধা ও চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এক্ষেত্রে সকল চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সকলকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
আগে আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন করা হতো। তাদের সঙ্গে যথাযথ আচরণ পর্যন্ত করা হতো না। চাকরি–বাকরি ও কর্মসংস্থানের কোনো উপায়ও ছিল না। সমপ্রতি অবশ্য তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা এবং সচেতনতা বেড়েছে। প্রতিবন্ধীদের অসহায় অবস্থার অবসান, দক্ষতা বাড়ানো ও জীবন মানোন্নয়নে আমাদের দেশে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ, প্রতিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান, যাতায়াত সুবিধা, ক্রীড়া–সংস্কৃতি ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানে ২০০১ সালের প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আমাদের সমাজের বোঝা নন। তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে, শিক্ষিত করা গেলে তাঁরাও আমাদের দেশের সম্পদে পরিণত হবেন। তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডেটাবেইস থাকাটা খুব জরুরি। তাহলে সেই ডেটাবেইস দেখে যিনি যেখানে যোগ্য, সেখানে তাঁকে চাকরি দেওয়া সম্ভব হবে। আমরা চাই সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে। একজন প্রতিবন্ধী মানুষ পরিবার বা সমাজ থেকে হেয়প্রতিপন্ন হলে তাঁর নিজের কাছেও ছোট মনে হয়। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। আমাদের সমাজকে উন্নয়ন করতে হলে সমভাবে এগিয়ে যেতে হবে।