শিশু কিশোরদের মনের জগতটা খুবই রঙিন। তারা সব সময় হাসি খুশিতে থাকতে চায়। আনন্দে সময় কাটাতে চায়। বেশিরভাগ শিশু ছুটাছুটি করতে বেশি পছন্দ করে। রঙিন কোনো কিছুর প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। তারা অতি সহজে উৎফুল্ল হয় আবার সহজে মন খারাপও করে। একটি রঙিন বেলুন একটি শিশুকে অনেক আনন্দ দিতে পারে। আবার বেলুনটি চুপসে গেলে শিশুটি মন খারাপ করে। রঙিন প্রজাপতির পেছনে শিশু ছুটে বেড়ায়। একটি পাখি দেখলে তার মন আনন্দে নেচে উঠে। পাখির ডাক শুনে সে হাসে। পাখির সাথে সে কথা বলতে চায়। আরো ছোট ছোট কত কিছু আছে যেসব একটি শিশুর মনকে ভরে দিতে পারে। একটি বিড়াল ছানা, পোষা কবুতর এমনকি হাঁস-মুরগিও শিশুদের অনেক আনন্দ দেয়। শিশুরা এদের সাথে খেলা করতে চায়। এজন্য শিশুর শারীরিক বেড়ে উঠার পাশাপাশি মনের বিকাশ একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে একজন শিশু পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। শিশু কিশোররা ঘুড়ি উড়াতে অনেক পছন্দ করে। রঙিন ঘুড়ি আকাশে যখন উঠে এরা তখন অনেক আনন্দ পায়। ঘুড়ির পেছনেও আবার তাদের ছুটতে হয়। এতে তাদের জড়তা কেটে যায়। তারা উৎফুল্ল থাকতে পারে।
শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে তুলতে পারলে তাদের মননশীলতা তৈরী হয়। সেরকম সুযোগ খুব কম শিশুরা পায়। স্কুলে শিক্ষার পাশাপাশি শিশু কিশোরদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা দরকার। ছবি আঁকা, কবিতা আবৃত্তি, গান, নাচ, অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা, বির্তক ও রচনা প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের মনোজগতকে আলোকিত করা যায়। এসবের মধ্য দিয়ে তাদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটবে এবং তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। তাদের মাঝে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে মানসিকতা তৈরী হবে। সংকীর্ণতা পরিহার করে বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করবে। সবচেয়ে বড় কথা একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। মনের বিষণ্নতাকে দূরে ঠেলে দিতে পারবে। বিষণ্নতা যে একটি মারাত্মক ব্যাধি তার থেকে দূরে থাকতে পারবে। একটি ভালো গান শুনলে একটি ভালো নাটক দেখলে মনটা হালকা হয়ে যায়। মনের ঘাত প্রতিঘাতগুলো নিজে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। নিজেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া যায়।
এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। একসময় স্কুলে এসবের নিয়মিত চর্চা হতো। জাতীয় দিবসে প্রতিযোগিতা হতো। ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহণ করে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠতো। বৎসরে একটি নাটক হতো স্কুলের মাঠে। অনেকে অভিনয়ে যুক্ত হতো। সবাই এ নাটকের জন্য অপেক্ষা করতো। এলাকাবাসীরা নাটক দেখে কত আনন্দ পেতো। এসব অনুষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে কতই না আনন্দ মধুর হতো। শিক্ষকরাও এসব অনুষ্ঠানকে সফলকাম্য করার জন্য রাতদিন খেটে যেতো। সবাই উপভোগ করতো। পুরো গ্রামে আনন্দের ঢেউ বয়ে যেতো। এখন ছেলে মেয়েদের এসব কিছু আর নেই। শিক্ষকরা এসব থেকে অনেক দূরে। শিশু কিশোররা এসব কিছু ভাবতেও পারে না। তাদের মন মানসিকতা সেভাবে গড়ে উঠেনি। স্কুলে স্কুলে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক মিলে সে আনন্দঘন আন্তরিকপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করতো তা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।
তথ্য প্রযুক্তির এসময়ে ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু সহজে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছে। বিনোদনও অতি সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছা করলে সহজে একটি মুভি দেখতে পারে। জ্ঞান বিজ্ঞানের কাছেও যেতে পারে। ভালো মন্দ যেদিকে ইচ্ছা হয় সেদিকে যেতে পারে। এতে করে শিশু কিশোরদের মানসিক যে বিকাশ তা আশানুরূপ হয় না। প্রকৃতি থেকে তারা দূরে সরে যায়। ফুল পাখি গাছপালা সবুজ অরণ্য তাদের আর আনন্দ দিতে পারে না। স্কুলের সহপাঠি বন্ধু বান্ধবদের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়। কারো সাথে মিশতে চায় না। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মোবাইলেই সময় কাটায়। ধীরে ধীরে তারা অত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক অন্য সবকিছু থেকে থেকে সরে থাকতে চায়। এক ধরনের বিষণ্নতার ভেতর ডুবে যায়। সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। সারাক্ষণ মোবাইল স্ক্রীনে ব্যস্ত থাকে। এমনকি পরিবারের কাউকেও আর ভালো লাগে না। কেউ ভালো কথা বললে তা গ্রহণ করতে পারে না। তাদের আচরণে নানা রকম অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়।
এসব শিশু কিশোরদের স্বাভাবিক পথে বিকশিত করার জন্য বিদ্যালয়ের কোন বিকল্প নেই। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আনন্দদায়ক করে তুলতে হবে। সকল ছাত্রছাত্রীকে মনোযোগী করে তুলতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণমূলক পাঠদানের উপরে জোর দেয়া প্রয়োজন। ক্লাসের মধ্যে শিক্ষার্থীরা যেন বিষয়টি পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে। ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কটা যে আন্তরিকতাপূর্ণ একটি ইতিবাচক সম্পর্ক তা উভয়ের মাঝে থাকতে হবে। শ্রদ্ধার স্নেহের সাথে ভালোবাসা না থাকলে কোথাও সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশ থাকে না। একই সাথে পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক রীতিনীতি, মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিশু কিশোরদের সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। সহনশীল মনোভাব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকরাও ভালো দায়িত্ব নিতে পারে। একটি শিশুর সহনশীল মনোভাব তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অন্যকে সহজ গ্রহণ করার সক্ষমতা বাড়ায়। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মনোভাব তৈরীতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শিশুদের খেলাধুলা স্বাস্থ্য গঠনে খুবই উপযোগী। একই সাথে মানসিক বিকাশেও খেলাধুলা অনেক সহায়তা করে। নিয়মিত খেলাধুলার মধ্য দিয়ে শিশু কিশোরদের শরীর মন দুই-ই সমভাবে গড়ে উঠে। এখন বেশিরভাগ শিশু খেলাধুলার সুযোগ পায় না। খেলাধুলা থেকে বাইরে থেকে যায়। খেলাধুলা মনেও আনন্দ দেয়। শিশুরা সবসময় ছুটাছুটি করতে চায়। এরা এক জায়গায় বসে থাকতে চায় না। খেলাধুলা করলে দৌড়াদৌড়ি হয়। হাত পা আর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সহজে নড়াচড়া হয়। শরীর থেকে ঘাম ঝরে। এসব কিছু সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারি। নিয়মিত শরীর চর্চা শিশু কিশোরের মন মানসিকতাকেও সতেজ করে রাখে। হা-ডু-ডু এক সময়ের খুব জনপ্রিয় খেলা। এখন আর সেসব নেই। গোল্লাছুট ও দাড়িয়াবান্ধা খেলা নেই বললেই চলে। ফুটবল খেলা খেলেনি এমন কাউকে পাওয়া যায় না। আগেকার দিনের কিশোরেরা পুকুরে গোসল করে সাঁতার কাটার সুযোগ পেতো। সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের এপার থেকে ওপারে চলে যেতো। আবার সাঁতার কেটে ফিরে আসতো। পুকুরে গোসল করার মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। মনের আনন্দে সাঁতার কেটে সাঁতার শিখতে হয়।  সাঁতার না জানলে পানিতে ভাসা যায় না। সাঁতারের সময় শরীরের হাত-পার ব্যায়াম হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসেরও কাজ হয়। আবার কোনো সময় সাঁতার প্রাণ বাঁচাতেও সাহায্য করে। ছেলে মেয়ে উভয়ের সাঁতার জানা দরকার। নিয়মিত সাঁতার কাটলে শরীরের সাথে মনও ভালো থাকে। গ্রামের ছেলেরা সাঁতার জানলেও শহরের ছেলেরা সাঁতার কাটার সুযোগ পায় না। সাধারণ ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে সাঁতার যেন হারিয়ে গিয়েছে। অনেকে বিভিন্নভাবে সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করলেও তা একেবার সীমিত অনেকটা অপ্রতুল। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা এসবের বাইরে যায়। এসব জায়গায় সাঁতার শিখলেও তারা ভালো করে সাঁতার কাটতে পারে না। পুকুরে বা অন্য কোথাও যেখানে পানি বেশি থাকে সেখানে তারা সাঁতার কেটে বেশি দূর এগুতে পারে না। এখন আবার সব শিশু কিশোরের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করা দরকার।
ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার জন্য শুধু পাঠ্য বইমুখী করে রাখা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার পথে একটি অন্তরায়। বাস্তব ক্ষেত্রে এরা কেবল বইমুখী থাকে না। মোবাইলের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। পড়ালেখার ফাঁকে যে সময়টুকু পায় সেখানে তারা মোবাইলে ব্যস্ত থাকে। মোবাইল একবার হাতে চলে এলে সৃজনশীল কাজ থেকে সে দূরে সরে যায়। মোবাইলের স্ক্রীন তাকে এতই আবদ্ধ করে তাতে সে অন্যকিছু করার সময় পায় না। কোনো কোনো স্কুল কলেজে অনলাইন ক্লাস চালু হলেও এতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয় না। এখানেও নানান সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মোবাইলের ফলে এদের পাঠ অভ্যাস অনেক হ্রাস পেয়েছে। সরাসরি বই পড়ার আনন্দ থেকে এরা বঞ্চিত হচ্ছে। একটি ভালো বই একজন শিশুর অনেক দিক খুলে দিতে পারে। তাই বই পড়ার অভ্যাস ছোট বেলা থেকে করতে হয়। বইয়ের মাঝে যে আনন্দ তা কখনো মোবাইল স্ক্রীনে পাওয়া যায় না। বই পড়লে কারো মন ভারী হয় না। ভাবনার পথগুলো খুলে যায়। অনেক কিছু জানা যায়। বেশি সময় মোবাইলে থাকলে একধরনের আসক্তি তৈরী করে। যা কোন ছেলে মেয়ের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। তাই তথ্য প্রযুক্তির এ জায়গাটিতে নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন।
তরুণ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অনেক বিষয়কে আবার নতুন আঙ্গিকে আনতে হবে। আগেকার দিনের সবকিছু নতুনেরা সেভাবে নেবে না। তাদের মন মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের আগ্রহ ও চিন্তা ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাদেরকে মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। শিল্প সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তরুণেরা এগিয়ে যেতে পারে। স্কুলে স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত খেলাধুলার চর্চা করা এবং গ্রামে ও শহরের ছেলে মেয়েদের জন্য খেলাধুলার আয়োজন করে তরুণ প্রজন্মকে ক্রীড়ার সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই তথ্য প্রযুক্তির জ্ঞান নির্ভর হয়ে গড়ে উঠতে হবে। একই সাথে মানবিক দিকগুলোও তাদের মন মানসিকতায় স্থান পেতে হবে। একজন তরুণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হলে তার মাঝে মানবিকতার একান্ত প্রয়োজন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার
        




