পাঠ অভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানা যায়। নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়। অনেক কিছু উপভোগ করাও যায়। ভালো সময় কাটে। মনটা হালকা হয়ে যায়। অস্থিরতা কেটে যায়। বিষণ্নতাও কেটে যায়। এলোমেলো ভাবনা থেকে দূরে থাকা যায়। ভালো মন্দের পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। অনর্থক কথাবার্তা থেকে বিরত থাকা যায়। অসদাচরণ থেকেও মুক্ত থাকা যায়। এমনকি ঝামেলা থেকেও কিছুটা দূরে থাকা যায়। ঝগড়া বিবাদ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা যায়। নিজের জগতে বিচরণ করা যায়। মনের জগতকে আলোকিত করা যায়। অনেক সমস্যার সমাধানও খুঁজে পাওয়া যায়। ভেবে চিন্তে পথ চলা যায়। সঠিক পথে চলতে সহায়তা করে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেও সহায়ক হয়। নিজের অধিকার নিয়ে যেভাবে সচেতন হওয়া যায় তেমনি অন্যের অধিকার সম্পর্কেও ভাবার সুযোগ করে দেয়। এভাবে পাঠ অভ্যাস জীবন চলার পথে আরো অনেক কিছু সহজ করে দিতে পারে।
এ পাঠ অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকে গড়ে তুলতে হয়। বিশেষ করে স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে গড়ে তুলতে পারলে এর সুফল পাওয়া যায় বেশি। পরিবার এ ক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। ছোটবেলা থেকে পাঠ অভ্যাস গড়ে তোলার পেছনে পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি। পরিবারের অন্যরা বই পড়লে ছেলেমেয়েরাও বইমুখী হয়। তবে স্কুলে যতগুলো পাঠ্য বই শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত থাকে সেগুলোও তারা পড়ে শেষ করতে পারে না। ফলে তাদের স্কুলের লাইব্রেরী থেকে পাঠ্যসূচির বাইরে অন্য বই নিয়ে পড়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে না। এখানে শিক্ষকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা। কিন্তু তা সেভাবে প্রতিফলিত হয় না। বেশির ভাগ শিক্ষকদের বই পড়ার মানসিকতা নেই বললে চলে। শিক্ষার্থীরা যে পাঠ্য বইগুলো ভালো করে পড়ে তাও নয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ্য বইয়ের চেয়ে গাইড বই পড়তে স্বাছন্দবোধ করে। স্কুলের শ্রেণী কক্ষের পাঠের চেয়ে কোচিং সেন্টারের লেকচারের প্রতি তাদের মনোযোগ বেশি থাকে। কোচিং সেন্টার ও গাইড নির্ভর লেখাপড়া শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বই থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দেয়। এদের আর সহজে পাঠ অভ্যাস গড়ে ওঠে না। মূল বই পড়ার আনন্দ থেকেও এরা বঞ্চিত হয়।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী থাকা বাধ্যতামূলক। লাইব্রেরীতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন ধরনের বই রাখতে হয়। একজন শিক্ষক লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু লাইব্রেরীতে বই পড়ার ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা একেবারে হাতে গোনা। টেবিল চেয়ারগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। কেউ কেউ অলস সময় কাটায়। লাইব্রেরী থেকে বই ইস্যু করে বাড়িতে নিয়ে পড়ার ছাত্র–ছাত্রী অনেক স্কুলে পাওয়া যায় না। আবার এমন স্কুলও আছে লাইব্রেরীর বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগ দেয় না। স্কুলে স্কুলে লাইব্রেরী গড়ে তেলা হয়েছে। প্রচুর বই এনে লাইব্রেরির আলমিরা–রেক ভর্তি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব বইয়ের কোন পাঠক নেই। বছরের পর বছর বইগুলো কেউ ছুঁয়েও দেখেনা। বইগুলো যেন রেকের মধ্যে শোভা পায়। পাঠক ছাড়া বইয়ের কোন মূল্য নেই। বই পাঠ করলে বইটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বইটিতে কি লেখা আছে জানা যায়। অনেক ভালো বইও লাইব্রেরিতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে। শিক্ষক শিক্ষার্থী কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে না। আসলে পাঠ অভ্যাস গড়ে ওঠায় যেসব উপকরণ তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই বললে চলে। বরং এর বিপরীত দিকে ধাবিত হওয়ার সুযোগ বেশি। শিশু কিশোরদের বইমুখী করে তুলতে হলে পড়ালেখা এদের কাছে আনন্দদায়ক হতে হবে। বই পড়ার মধ্যে এরা আনন্দ খুঁজে পেলে স্বাভাবিকভাবে পড়ার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ তৈরি হবে।
এখন বই পড়ার মধ্যে পাঠ অভ্যাস আর সীমাবদ্ধ নেই। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে পড়ার নানারকম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মোবাইল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলেও এর মাধ্যমে অনেক কিছু সহজে পাওয়া যায়। বই পড়া থেকে শুরু করে বিনোদনের হরেক রকম সুযোগ এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্য উপাত্ত অতি সহজে দৃশ্যমান হয়। বেশির ভাগ তরুণেরা মোবাইলের স্ক্রিনে নিজেদের ভুবন খুঁজে নেয়। যে কোন কিছু জানতে হলে তারা মোবাইলে বিচরণ করে এবং খুব সহজে তাদের জানার আগ্রহকে পূরণ করে। তবে বই পড়ার যে আনন্দ তা আর খুঁজে পায় না। কোন কিছু চেষ্টা করে আয়ত্তের মধ্যে যে তৃপ্তি তাও আর পায় না। খুঁজতে খুঁজতে বা চেষ্টা করতে করতে কোন কিছু পাওয়া গেলে তার আনন্দ আলাদা। এ আনন্দ অনেকদিন ধরে থাকে এবং বিষয়টিও মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে যায়। সহজে কোন কিছু পাওয়া গেলে তা আবার তাড়াতাড়ি মন থেকে মুছে যায়। যেসব শিক্ষার্থী লাইব্রেরীতে বসে বিভিন্ন বই পড়ে নোট করে তাতে শিক্ষার্থীর নিজস্ব স্বকীয়তা থাকে। আবার যারা গাইড অনুসরণ করে তাদের জানার মাঝে অনেক পার্থক্য থেকে যায়। এজন্য বই পড়ার বিকল্প অন্য কিছু নেই। বইয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার আনন্দ আলাদা। বইয়ের পাতায় পাতায় যেন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
অনেকের ধারণা এখন আগের মতো বইয়ের পাঠক নেই। পাঠক থাকুক বা কম থাকুক বই কিন্তু আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারী মাসে বই মেলাকে কেন্দ্র করে বইয়ের প্রকাশনা বহু গুণে বেড়ে যায়। ঢাকায় একুশের বই মেলায় এতো অধিক সংখ্যক বই প্রকাশিত হয় যা আগে কখনো হয়নি। মাসব্যাপী এ মেলায় বহু সংখ্যক পাঠকের সমাগম ঘটে এবং বিভিন্ন ধরনের বইয়ের বেচা বিক্রিও উল্লেখ করার মতো। বইয়ের পাঠক না থাকলে এতো বিপুল সংখ্যক বই প্রকাশিত হতো না। বেচা বিক্রিও এভাবে হতো না। শুধু ঢাকা শহরে নয়। বড় বড় বিভাগীয় শহরেও বইমেলার আয়োজন করা হয়। এসব মেলায়ও তরুণদের আনাগোনা সবেেচয় বেশি। বই নিয়ে তাদের আগ্রহ লক্ষণীয়। অনলাইনে বা মোবাইলে অনেক বই পাওয়া গেলেও পুস্তক আকারে বই পড়ার পাঠকের সংখ্যা কখনো কমে না। মেলা থেকে বই কিনে নিয়ে পড়ার মাঝে আলাদা আমেজ থাকে। একটা বই অনেকে পড়তে পারে, অনেকদিন পর্যন্তও পড়া যায়। কেউ কেউ বলে বই কিনে অনেকে কিন্তু সেভাবে পড়া হয় না। মেলায় সব লোকের সমাগম হয় তাদের অর্ধেকও বই কিনে না। তবে যে হারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে সে হারে পাঠকের সংখ্যা বাড়ছে না।
ডিজিটাল এ সময়ে তথ্য প্রবাহ থেকে শুরু করে সবকিছু সহজলভ্যতা হলেও এর যথাযথ ব্যবহার সহজ নয়। সমাজের ভালো যতো কিছু যেভাবে পাওয়া যায় আবার মন্দটা ততো সহজে পাওয়া যায়। ভালো মন্দের সংজ্ঞা নিরূপণ এতো সহজ নয়। ভালো মন্দ আপেক্ষিক একটি বিষয়। কোন কোন সময়ে বা কোন কোন ক্ষেত্রে ভালমন্দের তেমন ভেদাভেদ দেখা যায় না। আবার কোথাও একই রকম আচরণ বা চলাফেরা নানারকম বিভেদ তৈরি করে। ফলে এর ভেতর দিয়ে যাওয়া যতো সহজ এর থেকে উপকারিতা পাওয়া অতো সহজ নয়। কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণীরা সহজে এসবের দিকে ধাবিত হয়। অন্যরা যে ধাবিত হয় না তা নয়। তবে আবেগ উচ্ছ্বাস অনেক সময় তাদের তাড়িত করে বেড়ায়। মোবাইল স্ক্রিন থেকে এরা আর দূরে থাকতে পারে না। এর মাঝে নিজের জগতটাকে খুঁজে বেড়ায়। আসলে মোবাইল স্ক্রিন কখনো মনের প্রশান্তি দিতে পারে না। চিন্তা চেতনাকে প্রসারিত হতে দেয় না। মনকেও আটকে ফেলে। এর ভেতর দিয়ে এরা এক ধরনের অভ্যস্ত হয়ে ওয়ে। অন্য কোন কিছুতে আর মন বসাতে পারে না।
অনেকে মোবাইলে বই পড়ে, মুভি দেখে, গানও শোনে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তও এখান থেকে সংগ্রহ করে। তরুণ প্রজন্মের অনেকের এ অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এটা অবশ্যই ভালো অভ্যাস। আজে বাজে কিছু না দেখে বই পড়লে বা ভালো একটা মুভি দেখলে অনেক কিছু শেখা যায়। কিংবা গান শুনলে ভালো সময় কাটে। বিনোদনও হয় আবার জানারও সুযোগ হয়। সব জানা যে প্রয়োজনে আসবে তা নয়। তবু জানার মধ্যে এক ধরনের ভাল লাগা কাজ করে। এজন্য ছোটবেলা থেকে জানার আগ্রহ থাকা ভালো। শিশুরা অনেক কিছু জানতে চায়। কিন্তু এক সময়ে এরাও জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এমনকি কৈশোর পর্যন্ত তা আর পৌঁছে না। তারাও নানাভাবে মোবাইলে ঝুঁকে পড়ে। এতে করে এদের সৃজনশীলতা আর তৈরি হয় না। নিজে থেকে কোন কিছু করার প্রবণতা আর থাকে না। শিশু কিশোরদের ছড়া, কবিতা, গল্প বা ছবি আঁকার মধ্যে রাখতে পারলে তারা নিজেদের একটা জগত খুঁজে পায়। এর মধ্য দিয়ে তাদের পাঠ অভ্যাসও তৈরি হয়। এ জগতটা তাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়। তারা মননশীল হয়ে গড়ে ওঠতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে মননশীলতায় তৈরি করতে হলে তাদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সেটা যেভাবে হোক। আধুনিক ডিভাইসে হোক বা অন্য কোন মাধ্যমে হোক। তাদের পাঠ অভ্যাস গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।