‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার’। যৌবন ও তারুণ্য জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কবির এই আকাঙ্ক্ষা ছিল যৌবনের স্বর্ণালী দিনগুলোকে সঠিক ভাবে পরিচালিত করার। যুদ্ধ শব্দটির সাথে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এদেশের প্রতিটি আন্দোলন- সংগ্রামে যুব সমাজ এগিয়ে এসেছিল, আমাদের যুব সমাজ ঝাপিয়ে পড়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশের গণতন্ত্রের উত্থান পতনে আমাদের যুব-সমাজই বড় ভূমিকা পালন করেছে। এদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পদক্ষেপে ছাত্ররাই এগিয়ে এসেছিল বলে আমরা আমাদের যুব সমাজের সার্বক্ষনিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকি। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষগুলো তাদের সন্তানদের তেমন লেখাপড়ায় সুযোগ দিতে পারে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য দিকেও পারদর্শী করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালান। আর আমাদের আদরের সেই সন্তানরা কখনো কখনো জানা আজানা কারণে বিপথগামী হয়। অনেক মেধাবী ছাত্র অপরাজনীতির শিকার হয়ে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে যায়। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে অনেক ধরনের অপরাধ করে। আধিপত্য বিস্তার করতে জঙ্গি ও বোমাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেক দিন হত্যকান্ডের ঘটনা ঘটছে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ীদের শাস্তি না হওয়ায় বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অথচ যৌবনের এই সময়টি হচ্ছে আর্থমানবতার সেবায় ও দেশের সেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কিছু কিছু অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীর সংবাদ প্রকাশিত হয়। কারও বাবা হয়তো দিন মজুর কিংবা কারো মা গৃহিণী ও নাম না জানা আরো অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ। আবার কেউ কেউ সম্পূর্ণ অনাথ ও এতিম হয়েও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রথম আলো ট্রাষ্টের বৃত্তি পেয়ে সৌরভ চৌহান ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছে। তার সৌরভ ছড়াচ্ছে তার কষ্ট, চেষ্টা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে। নিজেদের বসতভিটা ও সহায়- সম্পদ বলতে কিছুই নেই, সৌরভের মতো সৌরভ ছড়ানো মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের এখন এগিয়ে আসতে হবে। আর্থিক বিষয়টি যেখানে অনেক বড় বিষয় তখন অনেকেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়েও শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা চালাতে পারে না। আমাদের প্রতিটি উচ্চ আসনে অবস্থিত ব্যক্তিদের অতীত শৈশব তেমন সুখকর ছিল না। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তাদের কষ্টকর বেড়ে উঠার গল্প জানিয়েছেন। তাদের বর্তমানে এই অবস্থানে আসার পিছনে তাদের মেধা, শ্রম, সততা ও অধ্যবসায় ছিল।এই মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিন্তু তাদের অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও প্রচেষ্টার ফলে তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পে এতটাই অনুপ্রেরণা জাগে যে অনেকেই এদের মাঝে নিজেদেরকে খুঁজে পান। আমাদের দেশে অনেক সচিব-শিক্ষাবিদ-অর্থনীতিক-সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং অনন্য প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিদের অতীত ইতিহাস অনেক অনেক অনুপ্রেরণামূলক। শৈশবের সেই দিনগুলো থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্থ কষ্টের যে বিবরণ দিয়ে থাকেন তখন বাস্তব চ্যালেঞ্জের অনুপ্রেরণা জাগে। অনুপ্রেরণামূলক এইসব মানুষগুলো সব সময়ের জন্য বর্তমান থাকে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের ও আমাদের সন্তানদের অবস্থান অনেকটাই বিপজ্জনক। সৎ পথে থাকার চেষ্টাও মাঝে মাঝে থেমে যায়। অসৎ ও অন্যায় পথটাকে মনে হয় সঠিক। চলার পথে অনেক ঘটনায় সৎ ও সঠিক পথকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যখন চারপাশে শুধু চাই আর চাই তখন না পাওয়ার মাঝে বেড়ে উঠা অদম্য সন্তানদের গল্পগুলো আমাদের নতুন নতুন স্বপ্ন দেখায়। আমাদের চারপাশে শুধু না পাওয়ার হাহাকার, চাওয়ার কোনো শেষ নেই, ক্ষুধার কোন শেষ নেই। আরো চাই, আরোও অনেক করে চাই। না পাওয়ার অনুযোগটি কন্ঠে লেগেই থাকে। অর্থের মাপকাঠিতে সবকিছুকে বিচার করতে গিয়ে তারা অর্থের বিনিময়ে সহজে সবকিছু পেয়ে যায়। বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পুরো জাতি মর্মাহত হয়। সারাটা বছর লেখাপড়া শেষ করে যখন চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরী করতে থাকে তখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মত ঘটনায় অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে যে ছাত্র-ছাত্রীরা অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ক্রয়ের স্বপ্নে বিভোর থাকে, শেষ পর্যন্ত তারা হয়তো প্রশ্ন হাতে পায়। আর না হলে প্রশ্ন পত্র ফাঁসের মত ঘটনা বার বার ঘটতো না। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রতি ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আমাদের তরুণদের মেধা- শ্রম- যোগ্যতা- দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমাদের তরুণ সমাজের একটা বিশাল অংশ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত, বিশেষ রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় অনেক নাম না জানা পথশিশু ও টোকাই সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন অপরাধ করে চলছে। আইনকে নিজের হাতে নিয়ে সমাজের উচ্চ স্তরে অবাদে চলাফেরা করে, তাছাড়া অনেক মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী সঠিক ভাবে কাঙ্ক্ষিত ও অর্জিত চাকরি লাভে বঞ্চিত হয়ে অন্যায় ও অসৎ পথকে সঠিক পথ হিসেবে গ্রহণ করে। গ্রামাঞ্চলের কিশোর যুবকদের একটা বিরাট অংশ স্কুল-মাদ্রাসার গন্ডি পেরিয়ে আর লেখাপড়া চালাতে পারে না। আর্থিক ও যথাযথ সুযোগের অভাবে অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিতে পারে না। তাই এক ধরনের বেকার জীবন যাপন করে। গ্রামের পরিবেশে চাকরির ক্ষেত্র কম হওয়াতে তারা পিছিয়ে আছে। বর্তমানে ১৮ কোটি জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ হচ্ছে তরুণ। আর এই তরুণরাই হচ্ছে আমাদের প্রাণ শক্তি। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এই তরুণ শক্তিকে জন শক্তিতে পরিণত করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, সম্প্রতি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তরুণদের ব্যাপক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে “চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলাপমেন্ট ফর ইয়ুথ” সম্মাননায় ভূষিত করেছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ। পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রতি পাঁচজনের একজনের বয়স ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে এবং এক চতুর্থাংশের বয়স ১৪ বছরের নিচে। এদের সকলকেই একজন সুনাগরিক ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখনি কর্মমুখী ও জীবনমুখী পরিকল্পনার মধ্যে সময় দিতে হবে। দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হলেও অনেকে নানান প্রতিকূলতায় বি.সি.এস দেওয়া হয় না। তাই বেসরকারি পেশাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু চাকরি জীবনে এক পর্যায়ে একদিন সরকারী চাকরিজীবী ও একজন বেসরকারি চাকরিজীবীর প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য আছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়- ২০১৯ এর শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল তরুণ শিক্ষক, পেশায় ভবিষ্যৎ। এই প্রতিপাদ্যের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণদের পক্ষেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিতে নতুন সৃজন, ভাবনা সংযোজন এবং পুরানো জট ও জঞ্জাল অপসারণ করা তুলনামূলক ভাবে সহজ। তাই তরুণ সমাজকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী ও জীবনমুখী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সহায়তা দিতে হবে। তরুণরাই আমাদের উন্নয়নের গতিধারায় মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে কান্ডারীর ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম