চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১ জুলাই অনুষ্ঠিত ‘আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় তরুণ লেখক সম্মেলনের’ উদ্বোধনী দিবসে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। প্যানেল আলোচক ছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শেখ সাদী। ছিলাম আমিও। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। এছাড়া সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সাংবাদিক লেখক আলীউর রহমান।
ভালো লাগার বিষয় লেখালেখিকে ভালোবেসে কয়েক শত তরুণ সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁদের কেউ ফিচার লিখতে আগ্রহী, কেউ গল্প–উপন্যাস, কেউ ছড়া–কবিতা, কিংবা কেউ প্রবন্ধ লিখতে চান। দীর্ঘ সময় ধৈর্যসহকারে সবার বক্তব্য শুনে একটার পর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আলোচকদের দিকে। অভিভূত হলাম এ কারণে যে একজনও আসন ছেড়ে বাইরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। পেয়ারু ভাই, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন তাঁর বক্তব্যে। যেসব কথা তরুণ প্রজন্মের জন্য জরুরি ছিল। আনিস ভাইয়ের বক্তৃতায় রস থাকে। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ বক্তৃতায় মোহিত করেন সবাইকে। আমরা তিনজন মুখোমুখি হয়েছিলাম তরুণদের। সাদী ভাই পণ্ডিত মানুষ। অসাধারণ বলেন। সেদিনও দুর্দান্ত বলেছেন। বিশু দা কথাসাহিত্য নিয়ে বলেছেন। কথাসাহিত্যে শ্লীলতা–অশ্লীলতা, জীবনীভিত্তিক উপন্যাস রচনা ও প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা উপহার দিয়েছেন। আমি বলেছি কবিতা ও ছড়া বিষয়ে।
আসলে শিল্পীরা শিল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ অঙ্গীকৃত। একটা অতৃপ্ত মন সবসময় তাদের তাড়া করে ফেরে। সমস্ত শিল্পের মধ্যে সাহিত্যকে আমি একটু আলাদা ভাবি। আবার সাহিত্যেরই যতগুলি মুগ্ধ শাখা আছে, তার মধ্য থেকে আমি প্রাধান্য দিই কবিতাকে। কেননা, ‘কবিতা হচ্ছে এমন জিনিস, যার মধ্যে অন্তত এক ফোঁটা আত্ম–আবিষ্কারের চিহ্ন লেগে থাকে’। আমার ভাবনার সঙ্গে অন্যজনের ভাবনায় মিল নাও থাকতে পারে।
আমরা চারপাশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারবো না, অস্বীকার করতে পারবো না বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বর্তমান অগ্রগতির জগৎকে। কিন্তু সেগুলোকে হার মানাতে পারে একটি মাত্র বিষয়, সেটি হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন, মানুষের কল্পনাশক্তি। সেই স্বপ্ন বা কল্পনা শক্তির ছন্দোময় প্রকাশ হচ্ছে কবিতা।
আমি সাধারণত অল্পে তুষ্ট একজন মানুষ। যা পাই, তাতে তৃপ্তি পাই, তুষ্ট হই। ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন খাদ্য–অখাদ্যের বাছবিচার না করে যা সামনে পায় গোগ্রাসে খেয়ে ফেলে এবং তাতেই সন্তুষ্ট হয়, ঠিক তেমনি জীবনের নানা পরতে আমি যা পেয়েছি, তা–ই গ্রহণ করেছি এবং তুষ্ট থেকেছি। একমাত্র লেখালেখি ছাড়া। সাহিত্যের নানা শাখায় আমি টুকটাক বিচরণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখনো এমন কোনো লেখা লিখতে পেরেছি বলে মনে হয় না, যাতে আমি সহজেই তুষ্ট হই, তৃপ্তি পাই। তবে আমার লেখা যখন কারো ভালো লেগেছে বলে শুনি, তখনই খুশিতে নেচে ওঠে আমার মন। নিজের ভাবনাকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারার আনন্দই আলাদা।
২.
কবিতা ও জীবন একই জিনিষেরই দু’রকম উৎসারণ। আমি মনে করি, আমি সবসময় কাব্যময় জীবনযাপন করছি। তাই দিনমান আমি নিয়োজিত থাকি লেখালেখিতে। আমি আমার চারপাশের বাস্তবতাকে দেখি, সৌন্দর্যকে দেখি, প্রেম–ভালোবাসা দেখি, আবার দুঃখ ও ক্ষোভ দেখি। জীবনের এই অনিবার্য দিকগুলি থেকেই বেরিয়ে আসে কবিতা। একটা পঙ্ক্তির সাথে আরেকটি পঙক্তি। তবে পঙক্তিগুলো গুছিয়ে নিই কোনো এক সুবিধাজনক সময়ে–তা হতে পারে রাত্রে, হতে পারে দুপুরে অথবা বিকেলে। আবার সবসময় কবিতা ধরা দেয় না। হঠাৎ একটা পংক্তি এসে টোকা দেয় মনের দরজায়। তখন তাকে আটকাতে পারলেই পুরো কবিতাটি জন্ম নিতে পারে।
৩.
আমার প্রিয় কবির তালিকা দীর্ঘ। বিশেষ একটি কবিতার জন্য, বিশেষ একটি পঙক্তির জন্যও একেক জন কবি আমার কাছে ‘প্রিয়’ হয়ে ওঠেন। এই মুহূর্তে সবার নাম হয়তো বলা যাবে না। তবু তাঁদের কয়েকজনকে স্মরণ করার চেষ্টা করছি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান,
আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী ও হুমায়ুন আজাদ আমার প্রিয়দের তালিকায় শীর্ষে আছেন। এ ছাড়া ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া এক য়ুটোপিয়া অন্বেষণের ফসল, সুন্দরের দিকে চোখ/অনন্ত ঝর্নার জলে/এইভাবে খোঁজা শুরু হয় নুড়ি ও পাথরে/এবং সুন্দরের দিকে চোখ রেখে মূলত সত্যকে খোঁজা’ কবিতার জন্য রফিক আজাদ; ‘ও ডানাঅলা ঘোড়া/আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাও তোমার পিঠে এক নক্ষত্রের মতো/ ছেঁড়া এই বর্তমান থেকে রাজকুমারীর মতো’ কবিতার জন্য আবদুল মান্নান সৈয়দ; ‘তুমি সেখানেই ঠোঁট রাখো, যেখানেই আমার চুম্বন’–এর জন্য নির্মলেন্দু গুণ, ‘নখের ভিতর নষ্ট ময়লা চোখের ভিতর প্রেম/চুলের কাছে ফেরার বাতাস দেখেই শুধলেম– এখন তুমি কোথায় যাবে? কোন আগাটার জল ঘোলাবে? কোন আগুনের স্পর্শ নেবে রক্তে কি প্রব্লেম?’-কবিতার জন্য আবুল হাসান; ‘বালিকা আশ্রম’–এর জন্যে আবু হাসান শাহরিয়ার; ‘ব্যর্থ হয়ে আসে যদি প্রণয়ের এতো আয়োজন/আগামী মিছিলে এসো/ স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন’–কবিতার জন্য হেলাল হাফিজ; ‘অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালের’ জন্য ময়ুখ চৌধুরী; ‘মাছ কি জলের স্পর্শ বোঝে’ কবিতার জন্য বিশ্বজিৎ চৌধুরী; ‘প্রতিবেশীনীর জন্য এলজি’ কবিতার জন্য শাহিদ আনোয়ার; ‘শ্রাবণ তোমাকে মা বলে ডাকবে’ ও ‘সামপ্রদায়িক হিংসায়’ কবিতার জন্য ওমর কায়সার; ‘কৃষ্ণচূড়ার কাছে’ কবিতার জন্য সুজন বড়ুয়া আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন বহু আগেই। বিচ্ছিন্নভাবে আরো বহু কবিতা আমার ভালো লেগেছে। তার উল্লেখ করতে পারলে ভালো লাগতো।
দেশের বাইরে অন্য ভাষার কবিদের মধ্যে পাবলো নেরুদা ও পল এলুয়ার আমার প্রিয়। নেরুদার জন্ম ১৯০৪ সালে চিলির পাররাল শহরে। ১৯৭১ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এবং ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সান্তিয়াগোতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘অনুস্মৃতি’ অন্য অনেকের মতো আমারও প্রিয় বই। পল্ এলুয়ার ফরাশি ভাষার কবি। জন্ম ১৮৯৫ এবং মৃত্যু ১৯৫২। ‘সোহাগিনী, তুমি হাসির আড়াল থাকো’–তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।
৪.
আমার স্বপ্ন মানুষকে নিয়ে। মানুষের অগ্রগতি, সৌন্দর্য–চেতনা, সততার চর্চা আমাকে মুগ্ধ করে। তারপর আসে দেশের কথা, ভাষার কথা, মানচিত্রের কথা, স্বাধীনতার কথা। আমার সমস্ত কবিতা জুড়ে পাওয়া যায় এসবের নিখাদ অস্তিত্ব। কত মানুষ আছে সমালোচনায়। কতজন আছে নিন্দায়। আমি ওসবের তোয়াক্কা করি না। আমার কাজ নিয়ে আমি থাকি। এগিয়ে যাই।
৫.
নিজেকে প্রকাশ করা নিজের ভাবনা–চিন্তাকে অপরের মনে সংযোজিত করার অমোঘ ইচ্ছে অনেকের মতো আমারও। কবিতার মাধ্যমেই সেই ভাবনা–চিন্তার অধিকাংশই প্রতিফলিত হয়। আমরা জানি, ‘কবিতা চিত্তকে জাগিয়ে তোলে, দৃষ্টিকে প্রসারিত করে’। কবিতা দৃশ্যমান, শ্রব্যমান, ঘ্রাণলিপ্ত ও স্বাদযুক্ত। এক্ষেত্রে আমার অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা। আমি চাই, কবির সমস্ত উৎকৃষ্ট গুণাবলি আমার মাঝে থাকুক। শব্দের বিন্যস্ততায়, জীবনবোধের গভীরতায়, উপমা, চিত্রকল্প, প্রতীক, ছন্দ ও শৈল্পিক নিপুণতায় আমি উদ্ভাসিত হয়ে উঠি। প্রেমের, দুঃখের, বেদনার, বিপ্লবের, ধ্যানের পরিপূর্ণ প্রকাশ যেন আমি আমার কবিতায় প্রকাশ করতে পারি, সেই স্বপ্ন আমার নিরন্তর।
৬.
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছেন, ‘কবিতা দাবি করে সচেতনরকম অচেতনতা। বিশুদ্ধ অজ্ঞানতা যেমন কবিতার জন্ম দিতে পারে না, তেমনি পাণ্ডিত্য কবিতায় অপ্রয়োজনীয়’। জ্ঞান কবিতার দেহে কঙ্কালের মতো লুকিয়ে থাকে, টান করে রাখে কবিতাকে। কিন্তু পাণ্ডিত্য! ‘অন্তর্গত কলকজ্বা–যখনই প্রকাশিত হয়, হয়ে ওঠে স্তূপীকৃত ফাঁকির নমুনা’। সামপ্রতিক কিছু কিছু কবিতায় দেখা যায়–পাণ্ডিত্যের কৃত্রিম সামিয়ানা টাঙানো থাকে কবিতার শরীরের ওপর। ফলে তাতে আবেগ আহত হয়, হারাতে বসে কাব্যময় লাবণ্য। তবে অধিকাংশ কবিতা সময়কে ধারণ করে রচিত। তাতে প্রশংসিত হচ্ছে কবিচিত্ত, জাগ্রত হচ্ছে শিল্পীমন।
৭.
আজকাল তথ্য–প্রযুক্তি যুগ। সংযোগের যুগ। লেখার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। পাঠকের মানসগঠনে লেখকের ভূমিকা থাকা চাই। তরুণ লেখক সম্মেলনে যে–কথাগুলো উচ্চারিত হয়েছে, সেগুলোর ওপর জোর দিতে হবে। তরুণরাই যুগে যুগে তাঁদের ভূমিকা পালন করেছেন, আগামীতে পালন করবেন। সাহিত্যেও তরুণদের প্রাধান্য থাকবে সবসময়।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।