মানুষ কী চায়। মানুষ শান্তি চায়। শান্তিতে বসবাস করতে চায়। তবে শান্তিতে থাকাটা সহজ নয়। শান্তির জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তারপরও শান্তি আসে না। শান্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় পাওয়া যাবে তাও বুঝে ওঠতে পারে না। কী করলে শান্তি পওয়া যেতে পারে তাও ঠিক করতে পারে না। আসলে শান্তি কী বা কী করলে শান্তি আসে এসব নিয়েও মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। মানুষ কখনো অশান্তি চায় না। ঝামেলায়ও জড়াতে চায় না। তারপরও কেন যেন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। একবার জড়ালে আর সহজে বের হওয়া যায় না। শান্তির সাথে শৃঙ্খলার কথাটাও এসে যায়। শৃঙ্খলা না থাকলে শান্তি আসতে পারে না। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনের সর্বত্র শৃঙ্খলার গুরুত্ব অনেক বেশি। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেও সবসময় শৃঙ্খলা বজায় থাকা অপরিহার্য।
সবাই চায় ঝামেলামুক্ত শান্তিপূর্ণ জীবন। জীবন কখনো নিষ্কণ্টক হতে পারে না। নানাবিধ ঝামেলার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়। একটা শেষ হলে আরেকটা এসে যায়। মানুষ নিজের উন্নতি চায়। উন্নতির জন্য বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি মোকাবেলা করতে না পারলে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। মানুষের মাঝে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তবে বেশির ভাগ মানুষ সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্থ থাকে। এরা কখনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এদের চাহিদাও সীমিত। এরা নির্দিষ্ট গণ্ডির মাঝে বিচরণ করে। মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণ হলে এরা সন্তুষ্ট থাকে। এসব চাহিদা পূরণ করতে এদের ব্যস্ত থাকতে হয়। অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় পায় না। তারপরও যে একেবারে ভাবে না তা নয়। কোনো কোনো সময়ে এরাও সোচ্চার হয়। দাবী দাওয়া ও অধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়। আন্দেলন সংগ্রামে নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করে।
একসময়ের মধ্যবিত্ত যারা তাদের বড় একটি অংশ এখন আর্থিকভাবে অনেক সচ্ছল। বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি নেই বললে চলে। তাদের বেশিরভাগ উচ্চ বিত্তের কাছাকাছি আবার অনেকে নিম্নবিত্তে নেমে গিয়েছে। এজন্য মধ্যবিত্তের চহিদা আর আগের মত নেই। চাহিদার অনেক তারতম্য ঘটে গিয়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, ব্যয় বেড়েছে, চাহিদাও বেড়ে গিয়েছে। চাহিদা পূরণে তারা হন্যে হয়ে ছুটছে। সুখ শন্তি খোঁজার সময় কোথায়? আবার যারা নিম্নবিত্তে নেমে এসেছে তাদের অবস্থা কোনো দিকে যাওয়ার মতো নয়। না পারে সম্মানের সাথে বাঁচতে, না পারে চাহিদার ধারে কাছে ঘেঁষতে। আবার পারে না নিম্ন আয়ের মানুষের সাথে মিশে যেতে। তারপরও চাহিদা থেকে যায়, বেঁচে থাকার চাহিদা। চাহিদা কি কখনো শেষ হয়। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে চাহিদাও ততদিন থাকবে। তবে উচ্চবিত্তের চাহিদা, মধ্যবিত্তের চাহিদা আর নিম্নবিত্তের চাহিদার মাঝে অনেক ফারাক। কোনোটাই কোনোটাকে হার মানাতে পারে না।
শ্রেণিভেদে চাহিদার ভিন্নতা থাকলেও মানুষের চাহিদার শেষ নেই। একটা চাহিদা পূরণ হলে আরেকটা চাহিদা শুরু হয়। কিছু কিছু চাহিদা আছে শেষ হয় না। সবার ক্ষেত্রে এসব চাহিদা থাকে। এগুলো সাধারণ বা কমন চাহিদা হিসেবে পরিচিত। মৌলিক চাহিদাগুলোও সবার ক্ষেত্রে কমবেশি প্রযোজ্য। যদিওবা উচ্চবিত্ত বা বিত্তশালীর কাছে মৌলিক চাহিদা এখন আর চাহিদা হিসেবে থাকে না। তাদের চাহিদার ব্যাপ্তি অনেক বড়। গাড়ি বাড়ি তাদের কাছে চাহিদা বলে মনে হয় না। অঢেল ধন সম্পদের মালিক হয়েও তাদের চাহিদার শেষ নেই। তবে এদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর দশ ভাগের বেশি নয়। বিপুল সংখ্যক মানুষের যেসব চাহিদা তার ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এদের চাহিদা অনেকটা অভিন্ন। শিক্ষক চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ এ বিশাল জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। তারা একটা শান্তিপুর্ণ স্বাচ্ছন্দময় জীবন চায়। এরকম একটা জীবনের জন্য তারা নানামুখী কর্মতপরতায় ব্যস্ত থাকে।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব মৌলিক চাহিদা পুরণ করার পর অন্য চাহিদার দিকে মানুষ ধাবিত হয়। বেশির ভাগ মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের চাহিদা মোটামুটিভাবে পূরণ করা গেলেও চিকিৎসা ও শিক্ষায় অনেক পেছনে থাকতে হয়। চিকিৎসা সেবা সবার কাছে পৌঁছে না। আবার শিক্ষার আওতায়ও সব শিশুকে আনা যায় না। এ দুটি মৌলিক চাহিদা পুরণ না হলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। এজন্য যে কোনো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ অত্যাবশ্যকীয়। এসব চাহিদা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। মৌলিক অধিকারের পূর্বশর্ত সর্বাগ্রে মৌলিক চাহিদা পূরণ। সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার থাকে। এ অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যায় না।
মৌলিক অধিকারের ব্যপ্তিও অনেক বড়। অনেক বিষয় মানুষের মৌলিক অধিকারের আওতাভুক্ত। এসব অধিকার যে কোন নাগরিকের ভোগ করার সুযোগ থাকতে হয়। মৌলিক অধিকারের অন্যতম মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কেউ বলে বাক স্বাধীনতা আবার কেউ বলে কথা বলার স্বাধীনতা। মানুষ সাধারণত কথা বলতে চায়। বিশেষ করে এ অঞ্চলের মানুষেরা কথা না বলে থাকতে পারে না। কথার মধ্য দিয়ে ভাবের আদান প্রদান হয়। পারস্পারিক বন্ধন তৈরী হয়। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য পারস্পারিক বুঝাপড়া বা সমঝোতা খুবই প্রয়োজন। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মধ্য দিয়ে সামাজিক ভিত্তি মজবুত হয়। এতে করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ও সহমর্মিতার সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ তৈরী হয়। এভাবে সমাজ গড়ে উঠলে সেখানে বৈরীতার অবসান হয়।
মানবধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। এ নিয়ে অনেকে সোচ্চার হয়, প্রতিবাদ করে, নিন্দাও জানায়। কিন্তু মানবধিকার লঙ্ঘন কখনো বন্ধ হয় না। তীব্র প্রতিবাদ হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা থেমে যায়। পরে আবার শুরু হয় নতুন করে, হয়ত অন্য কোনো উপায়ে। যদিওবা মানবাধিকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সব মানুষের মানবধিকার রক্ষা করার ন্যায্যতা রয়েছে। মানুষই মানুষের মানবধিকার ক্ষুণ্ন করে, খর্ব করে, বিপন্ন করে। এজন্য স্বল্প সংখ্যক মানুষই দায়ী। বিশেষ করে শাসক গোষ্ঠীর হাতেই মানবধিকার ক্ষুণ্ন হয় বেশি। এর অন্যতম কারন তারা শাসন ব্যবস্থাকে ধরে রাখার জন্য দমন পীড়নের আশ্রয় নিয়ে থাকে। মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানোর নানা পথ খুঁজে নেয়। এতে পদে পদে মানবিধিকার লঙ্ঘন হতে থাকে। সহজে এর প্রতিকার পাওয়া যায় না। লঙ্ঘনের সীমা অতিক্রম করতে করতে অনেক দূর এগিয়ে যায়।
একসময়ে তরুণরা সোচ্চার হতে থাকে। বিশেষ করে ছাত্র তরুণরা প্রতিবাদ শুরু করে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দেয়। এতে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে সবাই আন্দোলন সংগ্রামে নেমে পড়ে। কলেজ বিশ্বাবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছেড়ে তারা রাজপথে নেমে আসে। তাদের প্রতিবাদ বিক্ষোভে বাধা আসে। নানামুখী বাধা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ঘাত প্রতিঘাত। এমনকি হতাহতের ঘটনাও ঘটে। ছাত্ররা আরো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাধারণ মানুষের সমর্থন ছাত্রদের দাবীর প্রতি বাড়তে থাকে। প্রতিবাদ সমাবেশ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। টিয়ার গ্যাস, রবার বুলেট, গুলি কোনো কিছুতে আর থামানো যায় না। ছাত্রদের সাথে সাধারণের মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্র হত্যা, শিশু হত্যা, কিশোর হত্যা, মানুষ হত্যা বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কোনো বাহিনী আর ছাত্র জনতার আন্দোলনকে থামিয়ে রাখতে পারে না। তাসের ঘরের মত সবকিছু ভেঙে পড়ে তছনছ হয়ে যায়। তরুণরা নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে।
মানুষের মাঝে আশা জাগে। মানুষ নিরাপদে থাকতে চায়। তরুণরা পুরাতন জঞ্জাল সরিয়ে নতুন করে শুরু করতে চায়। সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে চায়। গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সব ধরণের অন্যায় ও বৈষম্যের অবসান চায়। বৈষম্য বিরোধী সমাজ করতে চায়। বৈষম্যবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। শোষণ নিপীড়ন বঞ্চনার চির অবসান চায়। যে কোনো ধরনের হয়রানি ও ভোগান্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সকল প্রকার হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। কারো প্রতি অবিচার বা জুলুম নয়, সবার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে চায়। ধর্ম বর্ণ সকল ভেদাভেদের উর্ধ্বে ওঠে মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে চায়। দল মত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একসাথে এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চায়। তরুণদের এসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য ধৈর্য্য ও সহনশীলতার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সাথে এগিয়ে চলা বর্তমান সময়ের অন্যতম সোপান।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী।