তবুও হার মানেননি তারা

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

‘সমতা, বৈচিত্র্য এবং অন্তর্ভুক্তি, পানি আমাদের একত্রিত করে’- প্রতিপাদ্যে অনেকটা নীরবে ১১ ফেব্রুয়ারি চলে গেল বিজ্ঞানে নারী ও মেয়ে বিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস।
২০১৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। মেয়েদের পুরো জীবনটাই একটা যুদ্ধ। সংসার, সন্তান, ক্যারিয়ার-সবকিছু একসাথে সামলে নিতে হয়। কিন্তু এর মাঝেও হাল ছাড়েন না অনেক নারী। হয়ে ওঠেন সফলতার গল্পের নায়িকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সফল এমন তিনজন চট্টগ্রামের নারীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানে নারী দিবসের বিশেষ আয়োজন।

ফারহানা রুমঝুম ভুঁইয়া
গবেষণা আমার ভালো লাগার বিষয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ফারহানা মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফারহানা হারিয়েছেন স্বামীকে। এক বছর বয়েসী একটি সন্তান ছিল সে সময়, ফারহানা সবেমাত্র যোগদান করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গান, আবৃত্তি, লেখালেখি সবকিছুতে একসময়ের চ্যাম্পিয়ন ফারহানা হয়ে গেলেন অন্য জগতের মানুষ। গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে শুরু হল তার যুদ্ধ। যুদ্ধ এখনও করে যাচ্ছেন কিন্তু তিনি হারেননি। ২০২০ সালে স্কুপাসের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ১০ নারী গবেষকের একজন হয়েছেন তিনি এবং এই তালিকায় তিনিই ছিলেন তরুণ গবেষক। তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ফ্রন্টিয়ার্স ইন মেডিসিনের মতো স্বনামধন্য জার্নালে। তারা অনুসন্ধান করেছেন কোন কোন উদ্ভিদে সার্স কভ-২ এর বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে এমন রাসায়নিক যৌগ রয়েছে। তার গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রকাশনা থেকে। গবেষণা করেছেন কোভিড রোগীদের কেমন পুষ্টি দরকার তা নিয়ে। বিভিন্ন গবেষণা আরও প্রকাশিত হয়েছে হেলিয়ন এবং জার্নাল অব প্রোটিওমিঙে। বিনয়ী ফারহানার ভাষায়, ‘আমার যা ভালো লাগে আমি তাই করে যাই। গবেষণাটা আমার খুব ভালবাসার বিষয়। আমি নিতান্তই একজন খুদে গবেষক।’ এখন অনুসন্ধান করছেন বিভিন্ন সামুদ্রিক উদ্ভিদের অণুজীব প্রতিরোধী গুণাগুণ নিয়ে। ফারহানা পড়াশোনা করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বেলজিয়ামের ভ্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে সঙ্গীতে পেয়েছেন জাতীয় পুরষ্কার। ‘যেই কাজই করি না কেন তা হওয়া চাই পারফেক্ট’- এমনটাই ভাবেন ফারহানা।

ড. ফারাহ জাহান
মেয়েরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ায়রিং বিভাগের শিক্ষক ফারাহ একা গিয়েছিলেন বিদেশে পড়তে, সঙ্গে ছিল একমাত্র ছেলে নক্ষত্র। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে সন্তান সামলে পিএইচডি করা সম্ভব কিনা সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। কিন্তু সবকিছুকে উড়িয়ে শেষ করেছেন পিএইচডি, আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে হয়েছেন সেরা গবেষক, রিমোট সেন্সিং নিয়ে তার রয়েছে অভিনব উদ্ভাবন। অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্বের হাতছানিকে উপেক্ষা করে চলে এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাঝে নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে। ফারাহ-এর ভাষায়, ‘আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে ইমেজ প্রসেসিং, কম্পিউটার ভিশন এবং মেশিন লার্নিং। মূলত আমাদের চোখ দিয়ে আমরা দেখি আর মস্তিষ্ক দিয়ে সেটা অনুভব করি। তেমনি কম্পিউটার ক্যামেরা (চোখ) দিয়ে দেখে আর মস্তিষ্কের কাজটা আমরা তৈরি করি ইমেজের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ আর বিভিন্ন মেশিন লার্নিং এলগরিদমের সমন্বয়ে। আমার গবেষণার ক্ষেত্র জটিল রোগ নির্ণয়, যে কোনো স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম।’ এই পর্যন্ত তাঁর দশটি আন্তর্জাতিক জার্নাল আর নয়টি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দু’টি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তির মাধ্যমে সেরা গবেষক নির্বাচিত হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। ফারাহ পড়াশোনা করেছেন সেন্ট স্কলাসটিকাস গার্লস হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডি করেছেন অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মো. সিরাজ উদ্দিন ও জাহানারা আখতারের সন্তান আর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ খাইরুল ইসলামের স্ত্রী ফারাহ বলেন, ‘আমি মনে করি একজন নারী এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারে তার পরিবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমার মা সবসময় চেয়েছে আমি নিজে স্বাবলম্বী হই আর সৌভাগ্যক্রমে আমার বিয়ের পর আমার স্বামী উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে আমাকে অনেক সহায়তা করেছেন। তাছাড়া আমার দুই ভাই আর বাবা ও সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।’ ফারাহ স্বপ্ন দেখেন মেয়েরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। মেয়েরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। একজন মেয়ে যেন তার পছন্দের কাজ করতে পারে সেই ব্যাপারে পরিবার আর সমাজ নারীবান্ধব ভূমিকা পালন করবে।

সাবরিনা সামিন আলম
সংগ্রাম করে নিজেকে গবেষণায় নিয়োজিত রেখেছি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ায়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক সাবরিনা পিএইচডি চলাকালীন দুই সন্তানকে নিয়ে একের পর মর্যাদাপূর্ণ গবেষণার অ্যাওয়ার্ড পাওয়া কোনো বাঙালি নারীর পক্ষে কি সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব, ‘নেচার কমিউনিকেশন বায়োলজি’র মত বিশ্বমানের গবেষণা প্রবন্ধে নিজের কাজ প্রকাশ করে নিজের মেধাকে তুলে ধরেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ায়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক সাবরিনা সামিন আলম। গত তিন বছরে কানাডার সেরা তরুণ গবেষকসহ অর্জন করেছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড। এর মধ্যে রয়েছে পিঙ ডি এঙিলেন্স অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট মবিলিটি অ্যাওয়ার্ড, মাকগিল জিনোম সেন্টার অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ এনাটমি ট্রাভেল। কাজ করছেন মানুষের গঠনগত বিকাশ ও বিভিন্ন জিনের প্রভাব নিয়ে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ায়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেরা ফলাফলের জন্য অর্জন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক। অর্জন করেছেন কুইন এলিজাবেথ স্কলার খেতাব। তার গবেষণায় উঠে এসেছে কিভাবে বংশগত রোগের পেছনে জিন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। চার সন্তানকে নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ করে সফলতার সাথে পিএইচডি করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবু সাদাত নোমানের স্ত্রী সাবরিনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুই ভাইয়ের ১৮ বছরের ভিওআইপি ব্যবসা
পরবর্তী নিবন্ধ৮০২ নং কক্ষে নারীর রক্তাক্ত লাশ ও একজন ‘কামরুল হাসান’