গরমের তাপমাত্রা ৪০/৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিদ্যুৎ নেই। আইপিএস–এর চার্জ শেষ। দরজা–জানালা খুলে রাখলে যে একটু বাতাস ঢুকবে সে উপায়ও নেই। বিল্ডিং এর গা ঘেঁষে বিল্ডিং। হাই রাইজ বিল্ডিং। জীবন মানের উন্নয়ন আর উন্নয়ন। সব ঘামে ভিজে চুপাচুপ।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
প্রকৃতি কঠোর, কঠিন, রূঢ়। প্রতিদিনকার একটু একটু অবহেলা আর ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত রূঢ় রূপটা আর আড়াল করা যাচ্ছে না।
জলাশয় নেই, জলাশয় ভরাট করে আমরা উঁচু উঁচু ইমারত বানাচ্ছি। পাহাড় নেই। পাহাড় কেটে কংক্রিটের স্থাপনা গড়ছি। গাছ কেটে সড়ক বানাচ্ছি। প্রকৃতি ক্ষেপবে না কেন? প্রতিশোধ নেবেই না কেন? আবার গাছ শুধু লাগালেই হয়ে যায়? গাছ লাগানোর পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গাছের পরিচর্যা কে করে? আর গাছ লাগালেই কি গাছ এই মহীরুহে পরিণত হয়ে যায়? কত দীর্ঘ সময়ের, দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এই গাছ পরিণত হয়।
আমাদের শহরটা মনুষ্য বসবাসের উপযোগী থাকুক। যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তা তো গেছেই, নতুন করে আর কোনো ধ্বংস না হোক।
গাছ কেটে, পাহাড় কেটে, জলাশয় ভরাট করে আমরা নগর বানাবো। ইট কংক্রিটের নগরে তাপদাহে আমরা হাপিত্যেশ করবো– উফ, অসহ্য, এই পরিবেশে বসবাস করা যায় না বলে। কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস নিজ হাতেই করলাম সে কথা একবারও স্বীকার করবো না। আমরা সবুজ বনায়নের কথা বলে সেমিনার করবো। গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান– কর্মসূচি করবো। সেমিনার শেষে আবার নগর উন্নয়নের জন্য অবশিষ্ট বনায়ন ধ্বংস করবো। নগর উন্নয়ন করতে গিয়ে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো যে ভস্ম হয়ে যাচ্ছি তা দেখেও দেখবো না।
প্রকৃতি ধ্বংস করে এখন কান্নাকাটি করছি সবাই গরম, গরম, গরম! এই চট্টগ্রাম শহরে একসময় অনেক পুকুর, জলাশয় ছিল। এখন কয়টা আছে? প্রথম আলোর প্রদায়ক থাকাকালীন সময়ে নাসির ভাই একবার একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল। ‘নগরের পুকুর–দিঘি’ নামে। সে–সময় বেশ কয়দিন খাটাখাটুনি করে কয়েকটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। লালখান বাজারে তুলা পুকুর নামে একটা পুকুর ছিল। ২০০৭ সালে যখন সেই পুকুরের খোঁজ করতে যাই তখন গিয়েই দেখি পুকুর নেই। পুকুর ভরাট করে পুকুরের জায়গা জুড়ে বিশাল বস্তি গড়ে উঠেছে। তুলা পুকুর নামটা কী সুন্দর! পুকুর পাড়ে নিশ্চয়ই বড় কোনো তুলা গাছ ছিল!
আন্দরকিল্লায় রাজা পুকুর নামে একটা পুকুর ছিল। এখন আর পুকুর নেই। রাজা ত্রিদিব রায়ের নাম অনুসারে পুকুরের নামকরণ হয়েছিল রাজা পুকুর। পুকুর ভরাট করে ইমারত তৈরি করা হয়েছে।
গরীবুল্লাহ শাহ সোসাইটিতে একটা বড় দিঘি ছিল। মানুষের দখলে পড়ে পরবর্তীতে যেটা ডেবায় পরিণত হয়েছিল। আমি ২০০৭ সালে যখন সেই ডেবা দেখতে গিয়েছিলাম তখন সেখানে দিঘি, ডেবা কিছুই ছিল না। সব দখল করেছে বড় বড় হাইরাইজ বিল্ডিং।
আগ্রাবাদের বিখ্যাত ডেবারপাড়ও প্রথম দিকে নাকি বিশাল এক দিঘি ছিল। যদিও সেই দিঘি আমার শৈশব থেকেই আগ্রাবাদ ডেবার পাড় নামেই শুনে এসেছি। এখন সেই ডেবার কিছু কি অবশিষ্ট আছে কিনা তা অবশ্য জানি না।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদিঘি। চট্টগ্রাম আর লালদিঘি যেন মিলেমিশে একাকার। সেই বিশাল লালদিঘির বর্তমান অবস্থা দেখলে একটা বড়সড় চৌবাচ্চা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
আসকারদিঘির চারপাশে যেভাবে দখল করা হয়ে গেছে এবং ময়লা আবর্জনার স্তূপ করা হচ্ছে প্রতিদিন, আসকারদিঘিকে ময়লার ভাগাড় বললে কি খুব একটা ভুল হবে!
চট্টগ্রামের আরেক ঐতিহ্যবাহী দিঘি বলুয়ার দিঘি। দখলের থাবা থেকে কতটুকু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে বলুয়ার দিঘি জানি না আমি।
মোগলটুলি বাজার এলাকায় ছিল মগ পুকুর। দাম্মা পুকুর। মগ পুকুর ভরাট হয়ে গেছে অনেক আগেই। দাম্মা পুকুর এখনো কি আছে? নাকি সব নগরায়নের আগ্রাসনে বিলীন হয়ে গেছে?
এরকম পুরা চট্টগ্রাম শহরে কত শত পুকুর ছিল। এখন কতগুলো পুকুর কিংবা দিঘি আছে? যা ধ্বংস হয়েছে তা তো হয়েছে, কিন্তু যেগুলো ধুঁকে ধুঁকে এখনো টিকে আছে সেগুলোকেই বাঁচিয়েই না হয় নিজেরা বাঁচি।
প্রকৃতির নিজস্ব জগতটা ধ্বংস করে যখন আমরা আমাদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবো তখন প্রকৃতি তার স্বাভাবিক আচরণটা করবে কোন সুখে? প্রকৃতির প্রতিশোধ যে কতটা রূঢ় হতে পারে তা কি আমাদের মনুষ্য প্রজাতির দেখার বাকি আছে এখনো…
প্রকৃতি তার স্বরূপে থাকার জন্য আমাদের তো বেশি কিছু করার দরকার নেই। শুধু নিজেদের লোভী মনোভাবটাকে একটু লাগাম দিয়ে টেনে ধরলেই হবে। তা নাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প হয়ে যাবে একদা বাংলাদেশ ছিল “সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলায় ভরা নদীমাতৃক সোনার বাংলাদেশ।”