তদন্ত কমিটির কাজ শুরু, কমিটির দুজনকে নিয়ে প্রশ্ন

যমুনা অয়েলের এক লাখ লিটার ডিজেল গায়েব

হাসান আকবর | বুধবার , ১ অক্টোবর, ২০২৫ at ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরে লুটপাট চলছে। ট্যাংকের মাপের হিসাব পাল্টে লাখ লাখ লিটার তেল গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপো থেকে এক লাখ লিটারের বেশি তেল গায়েবের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডিপোকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ চক্র এসব তেল লোপাটের সাথে জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে ফতুল্লা ডিপো থেকে তেল গায়েবের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল সরেজমিনে কাজ শুরু করেছে। তবে কমিটির দুজন সদস্যকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যে ডিপো থেকে তেল গায়েব হয়েছে ওই ডিপোর ইনচার্জ এবং দেশের ডিপোগুলোর ইনচার্জকে তদন্ত কমিটিতে রাখায় এই প্রশ্ন তোলা হয়। এর পরিবর্তে বিপিসি শক্তিশালী কোনো তদন্ত টিম গঠন করে পুরো বিষয়টির নির্মোহ তদন্ত করলে ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

দৈনিক আজাদীতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘যমুনা অয়েলের এক লাখ লিটার ডিজেল গায়েব!’ শীর্ষক সংবাদের ব্যাপারে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন থেকে তদন্ত প্রতিবেদন তিন দিনের মধ্যে বিপিসিতে জমাদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে ৭০ লাখ লিটারের মতো জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এই তেলের সিংহভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) তেল আমদানির পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। বিপিসি ১৫ লাখ টনের কম ক্রুড অয়েল এবং বাকিটা রিফাইনড অয়েল আমদানি করে। আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হয়। বিপিসির আমদানিকৃত সব তেল পদ্মা অয়েল কোম্পানি, যমুনা অয়েল কোম্পানি এবং মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে বাজারজাত করে। চট্টগ্রাম থেকে এসব তেল নৌ, রেল ও সড়কপথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ দেয়া হয়। তবে বেশিরভাগ জ্বালানি তেল নৌপথে অয়েল ট্যাংকারে পরিবাহিত হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামঢাকা পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করার পর নৌপথে তেল পরিবহন কিছুটা কমে আসে। চট্টগ্রামের প্রধান ডিপো থেকে যেভাবে তেল পরিবহন করা হোক না কেন তা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির বিভিন্ন আঞ্চলিক ডিপোতে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে সেখান থেকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ দেয়া হয়।

প্রধান ডিপো ও আঞ্চলিক ডিপোতে তেল সংরক্ষণের জন্য বিশালাকৃতির ট্যাংক রয়েছে। স্টিল স্ট্রাকচারের এসব ট্যাংকে সারা দেশে অন্তত ১৩ লাখ টন তেল মজুদ রাখা যায়।

তেল পরিমাপের জন্য এসব ট্যাংকে ক্যালিব্রেশন করা হয়। অর্থাৎ ট্যাংকের অভ্যন্তরে তেলের পরিমাণ কত তা ট্যাংকে তেলের উচ্চতা হিসাব করে বের করা হয়। তাপমাত্রাজনিত কারণে কিছুটা এদিকওদিক হলেও স্টিল স্ট্রাকচারের ট্যাংকগুলোর ক্যালিব্রেশন প্রায় একই থাকে। কিন্তু ক্যালিব্রেশনে গোলমাল করে লাখ লাখ লিটার তেল গায়েব করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিক ট্যাংকের ক্যালিব্রেশনে দুই ধরনের রিপোর্ট পাওয়ার পর হাজার হাজার লিটার তেলের হেরফের ঘটছে।

যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপোর ২২ নম্বর ট্যাংকের ২০১৮ সালের ক্যালিব্রেশনে ৫৮০০ মিমি ডিপে হিসাব করা হয়েছে ৩৫ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৩ লিটার তেল রয়েছে। একই ট্যাংকের ২০২৫ সালের ক্যালিব্রেশনে ৫৮০০ মিমি ডিপে ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ১০১ লিটার হিসাব করা হয়েছে। একই ট্যাংকে দুই ধরনের ক্যালিব্রেশন তেলের পরিমাণ ৬৩ হাজার ২৯২ লিটার হেরফের হয়ে গেছে। এভাবে প্রায় প্রতিটি ট্যাংকেই ক্যালিব্রেশনের গোলমালে লাখ লাখ লিটার জ্বালানি তেল হাওয়া হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে সূত্র বলেছে, ডিপোকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ একটি চক্র কোটি কোটি টাকার তেল লোপাটের সাথে জড়িত। শুধু ফতুল্লা নয়, সারা দেশের ডিপোগুলোতে ট্যাংকে ক্যালিব্রেশন কেরামতি চলে।

যমুনা অয়েল কোম্পানির ফতুল্লা ডিপো থেকে তেল গায়েবের ঘটনায় তিন দিনের মধ্যে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছে বিপিসি। গতকাল বিপিসির মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহিদ হোসাইন স্বাক্ষরিত এক পত্রে যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এই নির্দেশনা প্রদান করেন।

যমুনা অয়েল কোম্পানি ফতুল্লা ডিপোর ঘটনা তদন্তে যে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে তাদের মধ্যে একজন ওই ডিপোর ইনচার্জ এবং অপরজন বছর তিনেক আগে ওই ডিপোর ইনচার্জ ছিলেন। এই ধরনের তদন্ত কমিটি দিয়ে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মন্ত্রণালয় কিংবা বিপিসি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুরো ঘটনাটি তদন্ত করালে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসত।

যমুনা অয়েল কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, কমিটিতে বিশেষজ্ঞ লোকজন রয়েছেন। ইচ্ছে করলেই একজন কর্মকর্তা ভুল বুঝিয়ে কিছু করতে পারবেন না। তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। ক্যালিব্রেশনে গোলমাল হতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বিপিসির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিষয়টিকে আমরা সিরিয়াসলি নিয়েছি। কোম্পানি নিজেরা তদন্ত করে একটি রিপোর্ট দিক। আমরা পুরো ব্যাপারটির উপর নজর রাখছি। যমুনা অয়েল কোম্পানির তদন্তে সন্তুষ্ট না হলে আমরা নিজেরাও তদন্ত করতে পারি। তবে বিষয়টিকে হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। ডিপোগুলো হচ্ছে অয়েল সেক্টরের প্রাণ। ডিপোকেন্দ্রিক যেকোনো দুর্নীতি ঠেকানোর ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংবিধান অনুযায়ী দেশে সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই
পরবর্তী নিবন্ধএবারের দুর্গোৎসবের মত নির্বাচনও হবে উৎসবমুখর পরিবেশে