চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পের বিলের নথিতে স্বাক্ষর ও ফাইল উপস্থাপন নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। একটি পক্ষের অভিযোগ, ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নন এমন একজন প্রকৌশলী চার নম্বর জোনে চলমান প্রকল্পের কাজের বিলের নথিতে স্বাক্ষর করে ঊর্ধ্বতনের দপ্তরে উপস্থাপন করেছেন। যার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তিনি সংস্থাটির দুই নম্বর জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান। তার দাবি, জোন প্রধান ও বিভাগীয় প্রধানের নির্দেশে স্বাক্ষর করেছেন। আবার জোন প্রধান বলছেন, এ ধরনের কোনো নির্দেশনা তিনি দেননি। এ অবস্থায় বিষয়টি তদন্তে গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে ১৫ কার্যদিসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য বলা হয়।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, জাইকার অর্থায়নে এক্সেস রোডের মিড আইল্যান্ডে ২ কোটি ৩২ লাখ টাকায় এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পটির বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের চার নম্বর জোনের দুই সহকারী প্রকৌশলী ও তিন বাতি পরিদর্শক ১২ আগস্ট চসিক প্রশাসক এবং পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগকারীরা হচ্ছেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমীর আবদুল্লাহ ও সবুজ মানিক আচার্য্য এবং তিন বাতি পরিদর্শক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মো. মহসীন ও মো. এয়াকুব আলী। অভিযোগে বলা হয়, ১৯ জুলাই কাজ সমাপ্ত না করে এবং বড় ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে নতুন বৈদ্যুতিক পোল স্থাপনের মাধ্যমে এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পে বিলের নথি উপস্থাপন করেন দুই নম্বর জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান। চার নম্বর জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সড়ক বাতি পরিদর্শককে না জানিয়ে গোপনে চুরি করে এবং চার নম্বর জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে এ কাজ করার অভিযোগ করা হয়।
এতে বলা হয়, ইলেকট্রনিঙ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতির জন্য নিয়োগ দেওয়া হলেও তাকে বৈদ্যুতিক রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিভাগে কাজ করেছেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের জন্য প্রশাসক মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন একান্ত সচিব মো. আবুল হাশেমকে। তিনি তদন্ত শুরুও করেছেন। এ অবস্থায় গতকাল মন্ত্রণালয় থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশনা পেয়েছি। এখন বিধি মোতাবেক তদন্ত করব।
চসিক প্রশাসকের একান্ত সচিব মো. আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, বিভাগীয় প্রধান আমাকে বলেছেন, যাকে ইচ্ছে তাকে দিয়ে কাজ করাতে পারেন। এখানে সড়কটি ২৪ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। সেক্ষেত্রে যেকোনো একজনকে দিয়ে করাতে পারেন বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় প্রধান। এ বিষয়ে জোন প্রধানকে জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, তিনি নির্দেশ দেননি। হয়ত বিভাগীয় প্রধান বলেছেন। বিভাগীয় প্রধান বলাতে তিনিও নাকি স্বাক্ষর করেছেন। আমার মনে হয়েছে সেখানে কোনো ঝামেলা আছে। তবে প্রশাসক মহোদয় যেহেতু লিখিত তদন্ত করতে বলেননি, তাই গভীরে আর যাইনি। প্রাথমিকভাবে ধারণা নিয়ে রাখছি। এখন যেহেতু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আসছে, বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে খতিয়ে দেখা হবে।
এ বিষয়ে চসিকের বিদ্যুৎ বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সবুজ মানিক আচার্য্য আজাদীকে বলেন, এঙেস রোডে জাইকার যে কাজটা হয়েছে সেটা চার নম্বরের জোনের অধীন। কিন্তু এটার বিল নথি উপস্থাপন করেছে দুই নম্বর জোনের প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান। যা তার এখতিয়ারে নাই। এটা এক ধরনের অনিয়ম।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমীর আবদুল্লাহ খান আজাদীকে বলেন, এঙেস রোডের মিড আইল্যান্ডে এলইডি বাতি স্থাপনের কাজটি ৪ নম্বর জোনের। কিন্তু চুরি করে সেগুলোর নথি ও বিল উপস্থাপন করছেন ২ নম্বর জোনের সরওয়ার আলম খান। এর আগেও ৪ নম্বর জোনের ইউটিলিটি স্থানান্তরে তিনি বিল করেছেন। বিষয়গুলো আমরা অভিযোগ করেছি।
অভিযোগের বিষয়ে উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরওয়ার আলম খান আজাদীকে বলেন, এঙেস রোডে জাইকার কাজ চলছে এবং সেটার ওয়ার্ক অর্ডার করেছিল সিভিল ডিপার্টমেন্ট। সিভিল থেকে হিসাব শাখায় রানিং বিল প্রেরণ করা হয়। যেখানে বিদ্যুতের ১১৮টি পোলের বিলও সংযুক্ত আছে। তাই হিসাব শাখা থেকে বিদ্যুৎ বিভাগের মতামতও চেয়েছে। এর প্রেক্ষিতে ঝুলন স্যার (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ) আমাকে পোল ঠিক আছে কিনা দেখতে বলেন। আমি দেখে এসে জানিয়েছি। এরপর জোন প্রধান বারী স্যার (রেজাউল বারী) ও বিভাগীয় প্রধান ঝুলন স্যারের নির্দেশে নোট লিখে স্বাক্ষর করি। সেখানে ঝুলন স্যার ও বারী স্যার স্বাক্ষর করেন। এখানে আমার দোষ কী? বস যদি নির্দেশ দেন তাহলে আমাকে পালন করতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রধান ঝুলন স্যার চাইলে দুই অথবা চার নম্বর জোন দিয়ে করাতে পারেন। তাছাড়া আমি তো বিভাগের বস না যে বিল ছেড়ে দিতে পারব। আমার ওপর যে অভিযোগ তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তার দাবি, তিনি ঠিকাদারি কাজে জড়িত নন এবং সেটা জেলা প্রশাসনের তদন্তে প্রমাণিত। এছাড়া ইলেকট্রিকের ওপর যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিএসসি করেছেন।
এ বিষয়ে জোন প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল বারী আজাদীকে বলেন, আমি সরওয়ার আলম খানকে ফাইল উপস্থাপন বা নোট লেখার জন্য কোনো নির্দেশনা দিইনি। আমার দপ্তরেও কোনো ফাইল পাঠাইনি। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে নির্দেশ দেওয়ায় স্বাক্ষর করেছি। তিনি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাই তার নির্দেশে অফিসিয়াল শৃঙ্খলার স্বার্থে আমি মানতে বাধ্য। আমাকে যখন স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছে তার আগেই সবকিছু রেডি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি সরওয়ার আলম খানকে বার বার জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কেন অন্য জোনের কাজের ফাইল স্বাক্ষর করেছেন। তাকে মানাও করেছি না করতে। তখন তিনি বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর নির্দেশে করছেন। আমার ঊর্ধ্বতন নির্দেশ দিয়েছেন বললে তো আমার কিছু করার থাকে না।
চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশ আজাদীকে বলেন, এঙেস রোড ২৭ নম্বর ওয়ার্ড তথা ৪ নম্বর জোনে এবং ২৪ নম্বর ওয়ার্ড ২ নম্বর জোনে পড়েছে। আবার উভয় জোনের প্রধান রেজাউল বারী। তিনি আমার কাছে ফাইল পাঠান। পরে জানলাম, সেখানে জুয়েল স্বাক্ষর করেছেন, অন্যজন করেননি। সেখানে মতামতের বিষয় ছিল। তাই উভয়ই করলেই ভালো। আবার অফিস চাইলে যেকোনো একজনকে দিতেই পারেন। সিভিলে তো একজনের কাজ অন্যজন দেখেন।