তত্ত্বাবধায়কের প্রধান ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব কীভাবে?

মতবিরোধ দলগুলোর

| বুধবার , ৩০ জুলাই, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় সনদের খসড়ায় সমস্যা দেখছেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নেতারা; যে কারণে আজ বুধবারের মধ্যে চূড়ান্ত খসড়ার জন্য দলগুলো তাদের মতামত লিখিতভাবে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রকাশের দুই দিন আগে জাতীয় সনদ নিয়ে সমস্যা থাকার বিষয়টি সামনে আসার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ প্রক্রিয়া ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বের কাঠামো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্পষ্ট মতানৈক্য দেখা গেল। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্যের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের বৈঠকে এ দুটি বিষয়ের বাইরে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পাল নিয়োগের সাংবিধানিক বিধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগের দিন সোমবারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় বাক বিতণ্ডা ও চাপাচাপির কারণে ক্ষোভও প্রকাশ করেছিল বিএনপি। সে দিন সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও তা হয়নি। খবর বিডিনিউজের।

২১তম দিনে সংলাপে যা হল : বৈঠকে শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে আলোচনার বিষয়বস্তু ও কী অগ্রগতি হল তা তুলে ধরেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। অপরদিকে নিজেদের অবস্থান কী ছিল এবং কেন ছিল তা নিয়ে কথা বলেন বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক পার্টিএনসিপিসহ কয়েকটি দলের নেতারা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে অংশগ্রহণকারী তিনচতুর্থাংশ দল একমত হয়েছে। মূল বিরোধ এখন প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে।

কমিশনের সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নে একটি পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠিত হবেপ্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। যদি এই কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারে, তবে প্রধান বিচারপতির মনোনীত দুই বিচারপতিকে যুক্ত করে সাত সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি র‌্যাংকডচয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে।

এই র‌্যাংকডচয়েস প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। দলটির দাবি, অচলাবস্থায় বিষয়টি সংসদে পাঠানো উচিত। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্তি ও ভোটিং প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে দেখছে।

নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা ছিল দিনটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সব দল জাতীয় সংসদে নারী আসন ১০০তে উন্নীত করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে। কেউ সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে, কেউ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিদের সংসদে আনতে চায়। কমিশনের পক্ষ থেকে প্রথমে প্রস্তাব ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনের একতৃতীয়াংশে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। পরে তা একচতুর্থাংশ এবং একপঞ্চমাংশ পর্যন্ত নমনীয় করা হয়।

আলী রীয়াজ বলেন, আমরা প্রায় ঐকমত্যের কাছাকাছি এসেছি। আগামীকাল (বুধবার) কমিশনের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হবে। আশা করছি তা অধিকাংশ দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

মহা হিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে কমিটি গঠনের বিধান সংযুক্তির প্রস্তাবে এখনো পূর্ণ ঐকমত্য হয়নি। তবে অধিকাংশ দল কমিশনের প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে। ন্যায়পালের নিয়োগ কার্যকর করার বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও, বিএনপি ও তার কয়েকটি মিত্র দল সংবিধানে নতুন বিধান না এনে বিদ্যমান আইনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছে।

রীয়াজ বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে যেসব বিষয়ের ওপর ঐকমত্য হয়েছিল, তার একটি তালিকা আগামীকাল (বুধবার) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। এ ছাড়া জাতীয় সনদের খসড়ার একটি কপি ইতোমধ্যে দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে। সংশোধনের পর আগামীকালই এ অংশটির নিষ্পত্তি করার আশা করা হচ্ছে। আমরা এখনো আশাবাদী যে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দাঁড় করাতে পারব। সব দলই কোনো না কোনোভাবে সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে, এটি ইতিবাচক দিক।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং প্রধানমন্ত্রী পদে একজনের মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছরএই চারটি ছাড়া অন্যকোনো বিষয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় না বিএনপি। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দেওয়া নতুন প্রস্তাবে আগের প্রস্তাবগুলোতে একমত মত না হলে সংসদের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে দলটি। তা না হলে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে ফিরে যেতে চায় বিএনপিএমনটা জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তনে গণভোটের ব্যবস্থা করেছি, যাতে কেউ এ ব্যবস্থা খুব সহজে পরিবর্তন করতে না পারে। জুডিশিয়ারি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং ওয়াচ ডগ হিসেবে গণতন্ত্রের রক্ষা কবজ হিসেবে কাজ করবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তি জীবনে ১০ বছরের বেশি এ পদে থাকতে পারবে না। সব কিছু আইনে না রেখে সংবিধানে নিয়ে এলে, সেটা তো সংবিধান আর থাকে না। হয়ে যাবে মহাভারত। সংবিধান ভারাক্রান্ত হোক, বিএনপি এটা চায় না তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, সবকিছু সংবিধানে নিলে সেটা আর সহজে সংশোধনযোগ্য থাকে না। বরং আইনগত কাঠামোর মধ্যেই এই সংবিধিবদ্ধ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, জুলাই সনদের এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, উচ্চকক্ষ, পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা ঐকমত্য হতে পারিনি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি। আশা করছি, আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি, কমিশন জুলাই সনদে সেই বিষয়গুলো যুক্ত করবে।

আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্র্যাকটিস করতে না পারলে গণতন্ত্র আবারো হুমকিতে পড়বে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটি সুস্পষ্ট ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি।

বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে পাঁচ সদস্যের কমিটির কথা বলা হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের ঐকমত্য আছে। কিন্তু বাছাই কমিটি যে নাম সংগ্রহ করবে বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে, সেখানে আমাদের আপত্তি হচ্ছে। অনেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই, আন্দোলনসংগ্রামে তাদের কোনো অবদান নেই। তাই এখানে শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আর নারীদের জন্য সংসদে বিদ্যমান ৫০ আসনে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। সরাসরি নির্বাচনে নারীদের ১০০ আসনে নিবার্চন করা বিষয়ে অধিকাংশ দলই একমত।

বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, নারী ১০০ আসন চাই এবং সরাসরি নির্বাচন চাই। ইউপি বা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মত তিনটা আসন মিলে সরাসরি নির্বাচন দেওয়া হোক।

ন্যায়পাল নিয়ে আলোচনা : ন্যায়পাল নিয়ে বিএনপির অবস্থান বাস্তবভিত্তিক জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, প্রথমে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠিত হোক, কার্যকর হোক, তারপর স্থায়ী কাঠামো আসুক। এক্ষেত্রে ন্যায়পাল নিয়োগ নিশ্চিত করা, একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় গঠন, ন্যায়পাল আইনের পুনর্বিন্যাস ও ক্ষমতা নির্ধারণ, যাতে তার সুপারিশ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হয়। এত বড় তদন্তমুখী প্রতিষ্ঠান যদি কোনো ফল দিতে না পারে, তাহলে সেটা জনগণের জন্য উপকারে আসে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩০ জুলাই : মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি ঘোষণা, মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ
পরবর্তী নিবন্ধমেঘনা আলমের পাসপোর্ট, মোবাইল ও ল্যাপটপের ফরেনসিক তৈরির নির্দেশ