তছনছ পতেঙ্গা জেলেপল্লী ৫শ পরিবার এখন অসহায়

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২২ at ৪:৫৬ পূর্বাহ্ণ

পতেঙ্গা আকমল আলী মৎস্যঘাট-সংলগ্ন জেলেপল্লীর বাসিন্দা চম্পা রাণী জলদাস। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু, মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। অসহায়ত্বের কারণ হিসেবে জানালেন, সোমবার রাতে পানি বৃদ্ধি পেলে তিন সন্তানসহ আশ্রয় নেন পতেঙ্গা বেড়িবাঁধে। মনে করেছিলেন, সকালে ফিরে যাবেন ঘরে। কিন্তু ফিরতে পারছেন না। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং তছনছ করে দিয়েছে তার বসতঘর। বলেন, হয়তো ঘর ঠিক করা যাবে। কিন্তু খাব কী? স্বামীর আয়ের একমাত্র সম্বল জালটিও যে ভেসে গেছে পানিতে।
শুধু চম্পা রাণী জলদাশের পরিবার নয়, জেলেপল্লীটির অন্তত ৫০০ পরিবার এখন অসহায়। যারা হারিয়েছেন সহায়-সম্বল। জীবন বাঁচালেও বেঁেচ থাকার অবলম্বন হারিয়েছেন তারা। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে পতেঙ্গা এলাকায় সোমবার রাত ১০টার পর থেকে ঝড়ো হাওয়ার তীব্রতা বাড়তে থাকে। এ সময় বৃদ্ধি পায় জোয়ারের পানি। রাত বাড়ার সাথে সাথে পানিতে তলিয়ে যায় আকমল আলী মৎস্যঘাট-সংলগ্ন জেলেপল্লীটি। ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় ঘরবাড়ি। জেলেপল্লীটি ছিল সাগরের দিকে। অর্থাৎ বেড়িবাঁধের বাইরে। তাই এখানে আঘাতটাও আসে সহজে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ জেলে পল্লীতে ৫০০ পরিবারের বাস। তবে সরকারি তালিকাভুক্ত জেলে আছে ৩০০। অর্থাৎ ৩০০ পরিবার। কম-বেশি সব পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক পরিবারের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, পানি বাড়ার সাথে সাথে তারা আশ্রয় নেয় বেড়িবাঁধ ও সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। পানি এত দ্রুত বাড়ছিল, মালামাল বের করা সম্ভব হয়নি। সকালে গিয়ে দেখেন, ঘরবাড়ি সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তাদের অন্যতম সম্বল কয়েক লাখ টাকা দামের জাল, কাঁচি, সুতা ও অন্যান্য উপকরণ ভেসে গেছে।
অনেকে জানিয়েছেন, নষ্ট হয়েছে মাছ ধরার নৌকা। ছোট ছোট বোটও ভেসে গেছে বলে জানান অনেকে। তবে প্রায় সব পরিবারের সদস্যরা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নগদ টাকাও নিয়ে বের হতে পারেনি। সব মিলিয়ে এ জেলেপল্লীতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে সিত্রাংয়ের প্রভাবে।
অবশ্য পানি বাড়লেও অনেকে জালসহ ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বের করার চেষ্টা করছিলেন বলে জানান। কিন্ত প্রাণহানি এড়াতে রাত ১২টার পর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে তাদের সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নেয়া হয়। এতে সহায়তা করেন স্থানীয় কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। রাতে প্রায় আড়াই হাজার বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়।
৩৯ নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, জেলেপল্লীটিতে সাড়ে তিনশ ঘর আছে। এর বাইরেও থাকতে পারে। তবে মৎস্য দপ্তরের কার্ডধারী জেলে আছে ৩০০। এখানে সবগুলো টিনের ঘর। প্রায় সব পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হযেছে। সতর্কতা সংকেত দেয়ার পর তাদের বের হতে বলেছি। কথা শুনেনি। বলেছে, সমস্যা হবে না। রাতে যখন পানি বেড়ে যাচ্ছিল তখন জোর করে বের করেছি। ওই সময় তারা ঘরের জিনিসপত্র নিতে পারেনি। অথচ বিকেল থেকে বারবার জালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে বেড়িবাঁধে বা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বললেও শুনেনি।
তিনি বলেন, জাল, ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র মিলিয়ে এখানে কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আগামীকাল (আজ) ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, সোমবার রাতে খাবারের ব্যবস্থা করেছি। জেলা প্রশাসকের সাথে কথা হয়েছে। কাল (আজ) দুই টন চাল পাঠাবেন। এছাড়া মৎস্য দপ্তরের ভিজিএফ চালও আজ বিতরণ করবেন বলে জানান তিনি।
হারিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন : গতকাল সকালে জেলেপল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, পানিতে তলিয়ে আছে ঘরবাড়ি। সবগুলোই টিনের ঘর। পানি একটু কমলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুরুষ সদস্যরা টিনসহ অন্যান্য মালামাল বের করার চেষ্টা করছেন। কেউ বের করছেন থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিলসহ ঘরের আসবাবপত্র। নারী সদস্যরা সেগুলো বেড়িবাঁধে পাহারা দিচ্ছিলেন। এ সময় বেশিরভাগ মানুষ অভিযোগ করেন, তারা কোনো খাদ্য সহায়তা পাননি।
জেলেপল্লীর বাসিন্দা লিটন দাস বলেন, কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছি। কিন্তু কোনো জিনিসপত্র বের করতে পরিনি। ঘরে নগদ ৮/১০ হাজার টাকা ছিল। পানিতে এ সম্বলও ভেসে গেছে। একই বক্তব্য ছিল রণজিৎ দাশের। তিনি বলেন, ঋণ নিয়ে জাল কিনেছি। সে জাল বের করতে পারিনি। ভেসে গেছে পানিতে। লুৎফুন্নেছা নামে এক গৃহবধূ বলেন, জাল ও নগদ টাকা বের করতে পারিনি। এখন আমরা খাব কী। সরকারি সহায়তা প্রত্যাশা করেন তিনি।
সীমা দাস নামের এক গৃহবধূ বলেন, কোনোরকমে ঘর থেকে বের হয়েছি। দুটি জাল উদ্ধার করতে পেরেছি। বাকি কোনো কিছু রক্ষা করতে পরিনি।
বিশেম্বর জলদাস বলেন, আমার দুটি বোট, ২০টি বিনি জাল এবং দুই লাখ টাকার মাছ ও মালামাল ভেসে গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে লক্ষ্মী দাস বলেন, প্রথমে বাতাসে ঘরের চাল উড়ে গেছে। এরপর ১০টার দিকে ঘর পানিতে তলিয়ে যায়। তখন কোনোমতে প্রাণ নিয়ে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছি। ঘরে মাছ বিক্রির লাখখানেক টাকা ছিল। সেগুলো বের করতে পারিনি। লক্ষ্মী দাস যখন কথা বলছিলেন তখন তার দুই সন্তানের বাবা ডুবে যাওয়া ঘর থেকে কোনোভাবে টাকা উদ্ধার করা যায় কিনা চেষ্টা করছিলেন। তখন পর্যন্ত টাকা না পেলেও জাল, ড্রাম, কিছু হাঁড়ি-পাতিল পাওয়া গেছে। সেগুলো পাহারা দিচ্ছিলেন লক্ষ্মী দাস।
এদিকে সিত্রাংয়ে কেবল ঘরবাড়ি নয়, আকমল আলী ঘাটের অনেক দোকানও ভেঙে গেছে। এসব দোকানে সংরক্ষণ করা হতো মাছ। এমনটি জানালেন অনিল নামে এক জেলে। দোকান মালিক শিবু প্রসাদ দে জানান, তার চারটি দোকানে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া এখানে অন্য ব্যাবসায়ীদের খাবারের দোকান, মুদি ও তেলের দোকানসহ বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলে পরিবারের বাইরে সাধারণ পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পতেঙ্গায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৮০ ভাগ দোকান গুদামে পানি
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকায় ভেসে এল ৫০টি মহিষ