ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেড়েছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্য

শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়িসহ রাতে চলাচলকারী নাইটকোচ বেশি টার্গেট

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ৪ মে, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগের সহজতর মাধ্যম ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক। আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনসহ নানা কাজে দেশের লাইফলাইনখ্যাত এই মহাসড়ক ব্যবহার করে দেশের বেশিরভাগ জেলার মানুষ।

কিন্তু এই ‘লাইফলাইন’ বর্তমানে পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের কাছে ‘ডেডলাইনে’ পরিণত হয়েছে। শুধু ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কই নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি মহাসড়কের অবস্থা একই। মহাসড়কগুলোতে দিন দিন ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। ডাকাত চক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পণ্যবাহী গাড়ি থেকে যাত্রীবাহী বাস, কার, মাইক্রোবাস, টেক্সি চালকরাও। তবে শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়িসহ রাতে চলাচলকারী নাইটকোচ ও নতুন ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো ডাকাতদের সবচেয়ে বেশি টার্গেট। যদিও পুলিশ বলছে, ডাকাতি ও পণ্য ছিনতাই রোধে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ওসব ডাকাত ও ছিনতাই চক্র নিত্যনতুন কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

মহাসড়কে ধারালো অস্ত্রের এলোপাতাড়ি হামলায় আহত হচ্ছেন অনেকে, খুনের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। স্বেচ্ছায় কে বা দিতে চায় সব, অবস্থা বেগতিক দেখে দিয়ে দিলেও নিস্তার নেই। কারণ শুরুই হয় আতঙ্ক দিয়ে। সব দিয়ে দেয়ার আগেই শুরু করে ছুরিচাপাতিদা চালানো। ভয় ছড়ানো ও দ্রুত অপারেশন শেষ করতেই এ কৌশল। মহাসড়কে সহজে চিকিৎসাও মেলে না। ভুক্তভোগীরা মামলাথানা পুলিশে জড়াতে চান না। সব মিলে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে মহাসড়ক।

চট্টগ্রাম চেম্বার, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ট্রাককাভার্ডভ্যান মালিক সমিতি, বাংলাদেশ ট্রাককাভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়ন, যাত্রী কল্যাণ সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে একের পর এক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রীসহ প্রশাসনিক বিভিন্ন সেক্টরে চিঠি দেওয়া ছাড়াও নানাভাবে চেষ্টা করে আসছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আমদানিরপ্তানির জন্য কোটি কোটি টাকার পণ্য বন্দরে আনার সময় একটি চক্র কৌশলে চুরি করে নিয়ে যায়। এতে আমদানি রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি মহাসড়কে ডাকাতের কবলে পড়ে চালকহেলপারের পাশাপাশি যাত্রীসাধারণ হতাহত হচ্ছেন। চিঠিতে নিরাপদে যাতে পণ্য আনা নেওয়া করা যায় এবং যাত্রীচালকহেলপাররা যেন নিরাপদে চলাচল করতে পারেএ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।

আন্তঃজেলা ডাকাতদের ২৫ গ্রুপ : আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যমতে বিভিন্ন মহাসড়ক ঘিরে আন্তঃজেলা ডাকাতদের অন্তত ২৫টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। প্রতি গ্রুপের হয়ে ১২ থেকে ২০ জন ডাকাত কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ডাকাতি প্রতিরোধ এবং ডাকাতের কবল থেকে যাত্রীদের রক্ষা করতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যাপারে কারও কাছেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মহাসড়কের ডাকাত গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, দিলীপ ওরফে সোহেল গ্রুপ, আবু জাফর গ্রুপ, মনু গ্রুপ, সাতক্ষীরার বিপ্লব গ্রুপ, বরিশাইল্যা বিল্লাল গ্রুপ, কুমিল্লা গ্রুপ, ময়মনসিংহ গ্রুপ, হুমায়ুন গ্রুপ, হীরা গ্রুপ, চিটাগাইংগ্যা নুরু গ্রুপ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহাসড়কে যারা ডাকাতি করে তারা দিনে ছোটখাটো পেশাজীবীর ছদ্মবেশে থাকে। তবে রাতের আঁধারে তারাই হয়ে উঠে ভয়ংকর। বেশিরভাগ সময় যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে চালকহেলপারকে জিম্মি করে তারা ডাকাতি করে। যাত্রীদের নির্যাতনের পর হাতপা বেঁধে রাস্তার পাশে নির্জন স্থানে ফেলে দেওয়া হয়। আবার নির্জন স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে কয়েকটি চক্র ডাকাতি করে। পণ্যবোঝাই ট্রাক অথবা কাভার্ড ভ্যান ছিনিয়ে নিয়ে তারা মালামাল বিক্রি করে দেয়। এরপর লুটের গাড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করে।

পণ্য লোপাটে ১৯ চক্র : পণ্যবাহী গাড়ি ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ করছে ১৯টি চক্র। চক্রের সদস্যদের মধ্যে কেউ পরিকল্পনাকারী, কেউ সোর্স হিসেবে কাজ করে। কেউ রাস্তায় ভাসমান হিসেবে থেকে গাড়ির গতি কিছুটা কমে এলে পণ্য চুরি করতে পেছনে উঠে পড়ে। কেউ আছে চোরাই পণ্য কেনা বেচায় মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। এছাড়া চোরাই পণ্য ক্রেতা হিসেবেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অনেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করে থাকে। কখনও ফেব্রিঙের রোল, কখনও পোশাক তৈরির সরঞ্জাম কিংবা অর্ডার করা পণ্য শিপমেন্ট প্রক্রিয়ার আগেই চুরি হয়ে যায়। তাদের মধ্যে মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে চট্টগ্রামের সাঈদ ও ঢাকার ফাহিম। দুইজনই এক সময় ট্রাক চালক ছিলেন। তারা এখন একাধিক ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের মালিক। এই দুই চক্রের বাইরে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে আরও ১৭টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে চক্রগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকাইয়া মনির, নোয়াখালাইল্যা বেলাল, চশমা জামাল, কোটিপতি বাবু ও তার ভাই বাবুল, হারুন, লুলা মনির, পানির ট্যাঙ্কি জাহাঙ্গীর, সোর্স বাবু, লোহা মিজান, পাখি, জামশেদ, ভাঙ্গারী দুলাল, মনোলাল, ফাহিমের ভাই নবী হোসেন, ইউসুফ ও পিচ্চি লোকমান। একেকটি চক্র একেক এলাকা ভাগ করে নিয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (এডমিন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে চোর চক্রের যোগাযোগ থাকায় এই কাজগুলো তারা সহজে করতে পারে। এটার কারণে কিন্তু বিদেশে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাবস্থায় দেখেছি, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো গোডাউন ভাড়া করে চোরাই পণ্য রাখে চক্রের সদস্যরা। কোনও কাভার্ডভ্যান যেন মহাসড়ক ছেড়ে আশপাশের গোডাউনে ঢুকতে না পারে সেজন্য জিপিএস সিস্টেম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে গার্মেন্টস মালিকদেরও এ বিষয়ে জানানো হচ্ছে। জিপিএস প্রযুক্তি লাগানো থাকলে কাভার্ডভ্যানটি অন্য পথে যাচ্ছে কিনা বা কোথাও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকছে কিনা তা নজরদারি করা সহজ হবে।

জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারকৃত পণ্য লোপাট চক্রের সদস্যরা জানিয়েছে, কাভার্ডভ্যান কুমিল্লা, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড বা চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার পর সুযোগ বুঝে পুরো চুরির কাজ শেষ করা হয়। এসব পণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় বড় শপিংমলগুলোতে বিক্রি করা হয়। কিছু কিছু রফতানিও করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সদস্যরা আরো জানিয়েছে, অনেক কাভার্ডভ্যান চালক কারখানায় যাওয়ার আগে গাড়ির নম্বর প্লেট বদলে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি দিয়ে আসে। যাতে চুরির পর চালককে শনাক্ত না করা যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঢাবিতে ভর্তিচ্ছু ২৫ হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিবে চবিতে
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬