ঢাকায় একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে দিনে-দুপুরে গুলি করে হত্যা

আদালতে এসেছিলেন হত্যা মামলার হাজিরা দিতে দুই বছর আগেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৪:২৯ পূর্বাহ্ণ

রাজধানীর আদালত পাড়ার কাছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফটকে দিনেদুপুরে গুলি করা হয়েছে একসময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান সামী জানান।

মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক ফারুক হোসেন জানান। মামুনের খালাতো ভাই হাফিজ বলেন, আমার ভাই একজন সাধারণ মানুষ। কী কারণে তাকে কে হত্যা করল আমি জানি না। সে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত না। কারা তাকে হত্যা করেছে, কী কারণে করেছে আমার জানা নেই। খবর বিডিনিউজের।

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় ২০ বছরের বেশি সময় জেল খেটে ২০২৩ সালে জামিনে মুক্তি পান মামুন। তিন মাসের মাথায় তেজগাঁও বিজি প্রেস এলাকায় তাকে হত্যার চেষ্টা হয়। সে সময় রাস্তার ওপর মামুনের গাড়ি আটকে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হলে ভুবন চন্দ্র শীল নামে এক আইনজীবী গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

হামলার লক্ষ্যে থাকা মামুনকে খুন করতে না পারলেও সে সময় চাপাতি দিয়ে কোপায় হামলাকারীরা। মামুন সে সময় পুলিশকে বলেছিলেন, তেজগাঁওয়ের ওই হামলার পেছনে পুলিশের আরেক তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের হাত রয়েছে ।

গতকাল আদালত পাড়ার ঘটনার পর ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিওতে দেখা যায়, ফুল হাতা টিশার্ট পরিহিত মামুন দৌড়ে এসে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফটকের সামনে দিয়ে প্রবেশ করেন এবং মাস্কে মুখ ঢাকা এবং ক্যাপ পরা দুই যুবক পেছন পেছন এসে পিস্তল দিয়ে গুলি করে চলে যায়।

সেখানে দায়িত্বরত একজন নিরাপত্তারক্ষী বলেন, হত্যার শিকার ওই ব্যক্তিকে বেলা ১০টা ৫১ মিনিটের দিকে হাসপাতালের ফটক দিয়ে বের হন। প্রধান ফটক পার হয়ে একটু সামনে এগোনোর পর রাস্তা থেকে তার দিকে গুলি করে হামলাকারী দুজন। এরপর তিনি দৌড়ে আবার হাসপাতালের ফটকের ভেতরে ঢুকে পড়েন। তখন মাস্ক পরিহিত দুই হামলাকারী সিনেমার কায়দায় হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে গুলি করতে করতে হাসপাতালে প্রধান ফটক থেকে একটু ভেতরে ঢুকে পড়ে। পরে তারা কবি নজরুল কলেজের দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।

আদালতে এসেছিলেন হত্যা মামলার হাজিরা দিতে : ‘দুজন দুর্বৃত্ত তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তবে সেই গুলি গিয়ে লাগে হাসপাতালের জানালার গ্লাসে, তারা আরো পাঁচ রাউন্ড গুলি করেন। এর মধ্যে তিনটা গিয়ে মামুনের শরীরে লাগে।’ এভাবেই তারিক সাইফ মামুনকে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন হাসপাতালের নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বে থাকা মো. তারেক।

আইনজীবী মেহেদী হাসান বলেন, মামুন আদালতে এসেছিলেন ২৮ বছর আগের এক মামলায় হাজিরা দিতে। ফেরার পথে গুলিতে নিহত হন তিনি।

মামুনের বিরুদ্ধে মামলা হয় ১৯৯৭ সালে। ২৫ বছরের যুবক জাহিদ আমিন ওরফে হিমেলকে ১৯৯৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুর পিসি কালচার হাউজিং এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন হিমেলের বন্ধু সাইদও আহত হয়। এ ঘটনায় হিমেলের মা জাফরুন নাহার সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২/৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিক সাইফ মামুনসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অপর আসামিরা হলেন ওসমান, মাসুদ ওরফে নাজমুল হোসেন, রতন, ইমন ও হেলাল।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল২ এর বিচারক মমিনুন নেসার আদালতে এদিন মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক ছিল। আদালতে হাজিরা দেন মামুন। তবে কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এজন্য আদালত আগামী বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ঠিক করে। আদালত থেকে বের হন মামুন, এরপর যান ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে।

হাসপাতালের নিরাপত্তার কাজে দায়িত্বে থাকা মো. তারেক মামুনের গায়ে তিনটি গুলি লাগার কথা জানিয়ে বলেন, তাকে উদ্ধার করে জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। তবে অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। শুনেছি তিনি মারা গেছেন। শুনেছি যে লোক গুলিবিদ্ধ হয়েছে তার কাছে একজন ভিক্ষুক খাবারের জন্য টাকা ভিক্ষা চেয়েছিলেন। সেই টাকা দিতে নাকি তিনি হাসপাতালে এসেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, তিনি গাড়ি পার্কিং করতে এসেছিলেন।

যোগাযোগ করা হলে মামুনের আইনজীবী মেহেদী হাসান বলেন, তিনি (মামুন) আদালতে হাজিরা দিয়েছেন। মামলাটি ১৯৯৭ সালের। সাক্ষীরা আসে না। আদালতকে মামলাটি শেষ করার জন্য বলি। পরে আবার সাক্ষীর জন্য তারিখ ধার্য করা হয়। মামুন কেন হাসপাতালে গিয়েছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা তো বলতে পারব না। আমার অন্য মামলা থাকায় আমি চলে গিয়েছিলাম। তিনিও আদালত থেকে বের হয়ে যান। আমি জানি না। সে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত না। কারা তাকে হত্যা করেছে, কী কারণে করেছে আমার জানা নেই।

দুই বছর আগেও হত্যার চেষ্টা হয়েছিল : খুন হওয়া তারিক সাইফ মামুন একসময় পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। দুই বছর আগেও তাকে একবার হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর নিহত মামুনকে ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করেন তার স্বজনরা। তবে পুলিশ বলছে, মামুন একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী, যার অতীত অপরাধের বহু রেকর্ড রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মল্লিক আহসান সামী বলেন, এই মামুন হচ্ছেন সেই ইমামমামুন গ্রুপের মামুন। একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবেই পুলিশের খাতায় তার নাম রয়েছে।

মামুনকে লক্ষ্য করে আরেক গ্রুপের সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেলে থাকা আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তিন দিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে সন্ত্রাসীরা প্রাইভেট কারে থাকা মামুনের ওপর হামলা চালাতে গিয়েছিল। সে সময় লক্ষভ্রষ্ট গুলি ভুবনের মাথায় লাগে। মামুন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। পাশাপাশি আরিফুল নামে আরেক ব্যক্তি ওই ঘটনায় আহত হন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাসপাতাল থেকে যুবককে তুলে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি, গ্রেপ্তার ৩
পরবর্তী নিবন্ধদেশের ক্ষতি করে কাউকে বন্দর অপারেশন করতে দেয়া হবে না : নৌ উপদেষ্টা