সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল প্রায় ৫ ঘণ্টা ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ৭টি রাস্তার মোড় অবরোধ আটকে রাখার পর সরে গেছেন আন্দোলনকারীরা। যাওয়ার আগে আজ সোমবার ফের অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এদিনও তারা সারাদেশে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস–পরীক্ষা বর্জনের পাশাপাশি বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন।
গতকাল রাত ৮টার দিকে এ ঘোষণা দিয়ে শাহবাগ মোড় ত্যাগ করেন আন্দোলনকারীরা। কাছাকাছি সময়ে সাইন্স ল্যাবরেটরি, নীলক্ষেত, চানখারপুল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর ও কারওয়ান বাজার মোড়ও ছাড়েন আন্দোলনকারীরা। খবর বিডিনিউজের।
এর আগে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে দুপুর ২টার দিকে নীলক্ষেত থেকে মিছিল নিয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিকাল তিনটার দিকে নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেন ইডেন মহিলা কলেজ ও গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা। এরপর ৩টা ৫০ মিনিটে শাহবাগ অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর আগে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামন থেকে মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। ধীরে ধীরে আন্দোলনকারীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর ও কারওয়ান বাজার মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েন। অন্যদিকে চানখারপুল মোড় অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল, শহীদুল্লাহ হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। আগারগাঁওয়েও রাস্তায় নামের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের এই অবরোধের কারণে রাজধানীর এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সময় গড়ানোর সাথে সাথে পুরো রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিকালের এই কর্মসূচির কারণে অফিস ফেরত মানুষকে পড়েতে হয় চরম ভোগান্তিতে। ব্যস্ত কর্মদিবসে রাস্তা আটকে এমন কর্মসূচিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
দিনের কর্মসূীচির সমাপ্তি টেনে রাতে শাহবাগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলা ব্লকেডে শিক্ষার্থীরা অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে। আমরা কোটা সংস্কার করেই ঘরে ফিরব, কোনো আপস হবে না। আগামীকাল (আজ) বিকাল সাড়ে তিনটায় আবারও আমরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করব। আমাদের অবরোধ শাহবাগ থেকে ফার্মগেট ছড়িয়ে যাবে। ক্লাস–পরীক্ষা বর্জন অব্যাহত থাকবে।
এবার দাবি এক দফা : এদিকে বাংলানিউজ জানায়, সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে এতদিন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে অর্থাৎ ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। তবে এবার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিসহ সব গ্রেডে কোটাকে যৌক্তিক পরিমাণে সংস্কারের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাত পৌনে ৮টায় শাহবাগ থেকে শিক্ষার্থীরা এ দাবি ঘোষণা করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লেখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটা ন্যূনতম পর্যায়ে এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা সংস্কার করতে হবে। আন্দোলনের সমম্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এবার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেও কোটার যৌক্তিক সংস্কার চাই আমরা। আমাদের বারবার আদালত দেখানো হচ্ছে। আমরা তাদের সংবিধান দেখাচ্ছি। তিনি বলেন, কোটার বিষয়ে রাজপথ থেকেই ফয়সালা হবে। আলাপের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমরা আলোচনা করেছিলাম ২০১৮ সালে। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি প্রহসন।
ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ : সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহালসহ চার দফা দাবিতে কুমিল্লায় ফের ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ, জেলার বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সারাদেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই অবরোধে অংশ নেয় শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল ৪টার দিকে মহাসড়কের সদর দক্ষিণের কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। অবরোধের কারণে মহাসড়কের উভয়দিকে অন্তত ১০ কিলোমিটারজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। একই দাবিতে কুমিল্লা নগরীর পূবালী চত্বর দখল করে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ। পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী বিকাল ৩টায় এ আন্দোলন শুরু হয়।
কুমিল্লার ময়নামতি হাইওয়ে থানার ওসি ইকবাল বাহার বলেন, রাত ৮টার দিকে শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক ছেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় অবরোধের কারণে মহাসড়কের দুই দিকেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাত ৮টা থেকে যান চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘ জট লাগায় ধীরগতিতে যান চলাচল করছে। চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি।
এর আগেও গত ৪ জুলাই একই স্থানে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। পরে চার দফা দাবি জানিয়ে অবরোধ তুলে নেন তারা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। ওইদিনই রায় প্রত্যাখান করে ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করেন।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি দল ঢাকার শাহবাগের মোড়ে আন্দোলন করছেন গত ১ জুলাই থেকে। তাদের পূর্বঘোষিত গতকালের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে।