ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিহিত করেছে- বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া কোথায়?

| বৃহস্পতিবার , ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১১:১১ পূর্বাহ্ণ

কলামটি লিখছি ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখেবাংলাদেশের বিজয় দিবসে। এই বিজয় দিবসের কয়েকদিন আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ (গাদ্দার) অভিহিত করে বক্তব্য রাখা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন বাংলাদেশ সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে পরম বিস্মিত হয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে হয়তো আজো বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের ‘ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার’ যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতো। অতএব, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এহেন নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা আমার কাছে জাতিদ্রোহিতার শামিল মনে হচ্ছে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, কিন্তু তার মানে এটা হতে পারে না যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এভাবে অপমান করার পরও সরকার কোন প্রতিক্রিয়া জানাবে না।

শেখ হাসিনা স্বৈরশাসক ছিলেন, তাই তিনি নিজেই গণঅভ্যুত্থানে তাঁর উৎখাত হওয়ার পরিণামকে ডেকে এনেছেন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনতিনটি নির্বাচনকে একতরফা নির্বাচনী প্রহসনে পরিণত করে শেখ হাসিনা এদেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছিলেন। অতএব, গণঅভুত্থান ব্যতিরেকে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অন্য কোন পথ তিনি খোলা রাখেননি সামরিক ‘ক্যু দেতা’ ছাড়া। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এদেশে যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি সেজন্য মহান আল্লাহতাআলাকে হাজারো শোকরিয়া। কিন্তু, এই গণঅভ্যুত্থানের আড়াল থেকে এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যদি স্বাধীনতাবিরোধীদের দখলে চলে যায় সেটা বাঙালি জাতি কখনোই মেনে নেবে না। ৫ আগস্টের পর দেশের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর হয়েছে, একইসাথে কোথাও কোথাও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়েছে। এগুলো স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতশিবিরের নেতাকর্মীদের তান্ডব বোঝাই যায়। কিন্তু, প্রফেসর ইউনূস ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী নানা তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার কীভাবে এসব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপতৎপরতার ব্যাপারে নীরব থাকেন কিংবা নিষ্ক্রিয়তা দেখান সেটা আমার বোধগম্য হয় না। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ২০১০ সাল থেকে চৌদ্দ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে প্রফেসর ইউনূসের জীবনকে বিপর্যস্ত করার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে গেছেন তারও প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। তবুও আমাকে বলতেই হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক অবদানকে অস্বীকার কিংবা খাটো করা তাঁকে একেবারেই মানায় না। ১৯৭২৭৫ পর্বের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের ব্যর্থতা এবং ভুলগুলো সম্পর্কে তিনি সমালোচনামুখর হলে আমার কোন আপত্তি থাকবে না, আমি নিজেও ওগুলোর কঠোর সমালোচক। কিন্তু, কোন বিবেকবান বাঙালিই অস্বীকার করতে পারবে না যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব না পেলে জাতি স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারতো না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা একমাত্র স্বাধীনতাবিরোধীদেরকেই মানায়। তাই তাঁর প্রতি আমার একান্ত ফরিয়াদ, স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে সরকার ঘোষণা প্রদান করুক। শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন কোনমতেই যেন তাঁর ঐ স্বাধীনতার স্থপতির ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন না করে। প্রফেসর ইউনূসের জীবনের ছিয়াশি বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। তাঁর আর নূতন কোন চাওয়াপাওয়া থাকতে পারে না, তাই ইতিহাসের পাতায় প্রফেসর ইউনূস চিরস্থায়ী সম্মানের অধিকারী হওয়ার খাতিরে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে তাঁর অবস্থানের জানান দেওয়া এখন সময়ের দাবি মনে করি।

বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের’ যেসব নেতা সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের আধিক্য থাকার বিষয়টি জনগণের কাছে ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। তাদের কেউ কেউ এমনও বলা শুরু করেছে যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘দুই ভাইয়ের ঝগড়া’। তাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে নাকি ১৯৪৭ সালের চেতনা এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, ১৯৭১ সালে যার নাম ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ, তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্বাধীনতার বিরেধিতা করেই ক্ষান্ত ছিল না, তারা সরাসরি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ‘অক্সিলারী ফোর্স’ হিসেবে আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের মাধ্যমে গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। জামায়াতে ইসলামী গত ৫৪ বছরেও তাদের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তাদের কাছে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন এখনো গ্রহণযোগ্য রয়ে গেছে। অথচ, সারা বিশ্ব এতদিনে জেনে গেছে কী চরম বঞ্চনা, শোষণ, লুন্ঠন, পুঁজিপাচার ও বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। এখনকার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের জন্মই হয়নি ১৯৭১ সালে, কিন্তু ঐ নির্মম ইতিহাসের সাথে কি তাদের পরিচিত হতে হবে না? জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কধোলাইয়ের শিকার হয়ে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী বয়ানকেই কি তারা আঁকড়ে থাকবে? তাদের জন্য নিচের তথ্যউপাত্তগুলো উপস্থাপন করছি।

১৯৪৭১৯৭১এই চব্বিশ বছর ধরে পূর্ব বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুন্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজিপাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল সে সম্পর্কে গত ৫৪ বছরে সব তথ্যউপাত্ত এখন বিশ্বের সামনে উদঘাটিত হয়েছে। এতদ্‌সত্ত্বেও বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কোন বাঙালি কীভাবে আজো পাকিপ্রেমে বুঁদ হয়ে থাকে? কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয় সেটাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় হবে না। কিন্তু, পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্যে জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বা প্রধানমন্ত্রীর পদ কোন বাঙালিকে দেওয়া হয়নি। যদিও ঐপর্যায়ে পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে ছিল কিন্তু ২৪ বছরের অভ্যন্তরীণঔপনিবেশিকপর্বের শেষে এসে পাঞ্জাব এবং করাচী অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিচের তথ্যউপাত্ত থেকে এই ঔপনিবেশিক শোষণ, লুন্ঠন, বঞ্চনা ও পুঁজিপাচারের চিত্রটা কিঞ্চিৎ পাওয়া যাবে:

) প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানী আইটেমগুলো থেকে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কোরিয়া যুদ্ধ এবং প্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানি আয়ে একটা জোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় ঐ অনুপাত ৮০৮৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ, ঐ রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের একপঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

) ইঙ্গমার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ঐ বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ঐ ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ এবং অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

) পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণ গ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার এবং শিল্পপতিব্যবসায়ীরা কব্জা করে নিয়েছে।

) ঐ ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারী বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

) ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয়বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

) পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানীদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি পাঁচ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

) ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকী ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

) মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। এমনকি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সকল সোনাদানা এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে।

) ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী এবং অবাঙালিরা।

১০) যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএ’র বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১) পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচী, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান।

১২) ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ এবং এর শাখানদীগুলোতে বাঁধ এবং ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য ‘ক্রুগ কমিশনের’ রিপোর্ট বাস্তবায়নের কোন প্রয়াসই নেয়নি অর্থায়নের অভাবের কথা বলে। উক্ত সেচ ব্যবস্থার কারণে পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে, ঐ ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় আনা হয়েছিল।

স্বাধীনতাউত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, যা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যোৗক্তিক ছিল। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:

) মাথাপিছু জিডিপি’তে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে ৭০ শতাংশ পিছিয়ে ছিল, কিন্তু ২০২৫ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।

) বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চাইতে ২০ বিলিয়ন ডলার বেশি, ২০২২২৩ অর্থবছরে তা ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার।

) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালের মে মাসে আইএমএফ এর হিসাবপদ্ধতি মোতাবেক ২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেটা পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি।

) বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।

) বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।

) বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।

) বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১২ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। ফলে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটিরও কম।

) বাংলাদেশের ১২২ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ২৮০ রুপি লাগে। অথচ, ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপি’র বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় আট শতাংশ বেশি ছিল।

) বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপি’র ২২ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপি’র ৪৬ শতাংশ।

১০) বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ীর আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।

১১) বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানে ৫৯।

১২) বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।

উপরের তথ্যউপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না ইনশাআল্লাহ। পাকিস্তানের জনগণ এখন বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খুবই আগ্রহী, কিন্তু ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি (বিশেষত সেনাবাহিনী) বাংলাদেশের কাছে এখনো ক্ষমা প্রার্থনায় রাজি নয়। বাংলাদেশ যেখানে একটি দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে গোহারা হারিয়ে দৃপ্তপদে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে অযৌক্তিক পাকিপ্রেম কেন? পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই হবে প্রফেসর ইউনূসের সরকারকে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিসম্পুটে সতীর্থ-সুহৃদ ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো
পরবর্তী নিবন্ধআশেকানে মোস্তফা (দ.) তরুণ পরিষদ কুলগাঁও শাখার সভা