২০২৫ সালের জুলাই মাসে কলামটি লিখতে গিয়ে নির্দ্বিধায় বলতে পারছি যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিক্স বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোটে পরিণত হবে। ২০১৪ সালের ১৫ জুলাই ব্রাজিলের ফোর্টালেজা নগরীতে বিশ্বের নব্য–শক্তিধর ব্রিক্স দেশগুলো ব্রিক্স ব্যাংক নামের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। গুরুত্বের বিচারে এই ঘটনাটি যে ক্রমেই বিশ্ব–মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে তাতে আমার কোনই সন্দেহ ছিল না। কারণ, ব্রিক্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠার এই সিদ্ধান্তটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র, আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের অসহনীয় দাদাগিরির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটা সাহসী প্রয়াস হিসাবে যে ইতিহাসে চিহ্নিত হবে সে ব্যাপারে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। আজ ২০২৫ সালের জুলাই মাসে এসে আমার সে বিশ্বাস সত্যে পরিণত হয়ে গেছে। এখন ব্রিকস ব্যাংকের ফর্মাল নাম দেওয়া হয়েছে ‘নিউ ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক’। ইতোমধ্যেই বিশ্বের ১৯টি দেশ ব্রিকসের সদস্য হয়ে গেছে, যার মানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ এখন ব্রিকস জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ক্রয়ক্ষমতার সাম্যের ভিত্তিতে এসব দেশের সম্মিলিত জিডিপি বিশ্ব–জিডিপি’র ৪৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে।
ব্রিক্স (BRICS) শব্দটি বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ ও ব্যবসায়–গবেষণা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান–স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নীলের প্রবর্তিত একটি টার্ম যা তিনি উদ্ভাবন করেছেন ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না ও সাউথ আফ্রিকা–বিশ্বের এই পাঁচটি দ্রত–উত্থানশীল অর্থনীতির ইংরেজী নামের আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে। এই পাঁচটি দেশ বিশ্বের আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত, ২০১৪ সালে এগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪১.৬ শতাংশ ছিল এবং ঐ সময় বিশ্বের মোট জিডিপি’র ১৯.৮ শতাংশ এই পাঁচটি দেশ উৎপাদন করছিল। এগুলোর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটো দেশ চীন এবং ভারত যেমনি রয়েছে তেমনি রয়েছে আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়া। এই দেশগুলোর কোনটাকেই মাথাপিছু জিডিপি’র বিবেচনায় উন্নত দেশ বলা যাবেনা—আইএমএফ এর হিসাব মোতাবেক ২০১৪ সালে রাশিয়ার মাথাপিছু জিডিপি ১৪,৬০৪ মার্কিন ডলার এই পাঁচটি দেশের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। ব্রাজিলের মাথাপিছু জিডিপি ঐ সময় ১১,১৭১ মার্কিন ডলার হলেও অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার আয়বৈষম্যের কারণে দেশটির সাধারণ জনগণ তখনো উন্নয়নের সুফল থেকে অনেকখানি বঞ্চিত রয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাথাপিছু জিডিপি ঐ সময় ছিল ৭,৮১০ মার্কিন ডলার, কিন্তু ওখানকার অশ্বেতাঙ্গ জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তখনো অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার ছিল। চীনের মাথাপিছু জিডিপি ঐ সময় ৬,৭৬৮ মার্কিন ডলার হলেও চীন তখনই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি তখন ছিল মাত্র ১,৪১৮ মার্কিন ডলার। তাই ভারতকে তখনো অনায়াসে একটি নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ বলা যেত। মাথাপিছু আয়ের বিচারে এই পাঁচটি দেশের কোনটিকেই উন্নত দেশের কাতারে ফেলা না গেলেও বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির এর আগের দুই দশকের ধারাবাহিকতায় এই ব্রিক্স নামধারী দেশগুলো চমকপ্রদ সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধোত্তর পর্বের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার অবস্থানে চলে এসেছিল। ক্রয় ক্ষমতা সাম্যের (ঢ়ঁৎপযধংরহম ঢ়ড়বিৎ ঢ়ধৎরঃু বা পিপিপি) ভিত্তিতে হিসাব করা হলে চীনের জিডিপি ২০১৪ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এবং এই ভিত্তিতে ভারতও ২০৩০ সালের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল। তার মানে, পিপিপি পদ্ধতিতে হিসাব করলে ২০১৪ সালেই ব্রিক্স এর অবদান বিশ্বের জিডিপি’র ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। অতএব, ২০১৪ সালেই এই জোটটিকে বিশ্ব অর্থনীতির নব্য–পরাশক্তি হিসাবে অভিহিত করা হতো। আইএমএফ এর সর্বশেষ প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সালে রাশিয়ার মাথাপিছু জিডিপি নির্ণীত হয়েছে ১৪,২৫৮ ডলার, চীনের মাথাপিছু জিডিপি ১৩,৬৮৮ ডলার, ব্রাজিলের মাথাপিছু জিডিপি ৯,৯৬৪ ডলার, দক্ষিণ আফ্রিকার মাথাপিছু জিডিপি ৬,৩৯৭ ডলার এবং ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২,৮৭৮ ডলার। এই সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালের তুলনায় চীন ও ভারতের মাথাপিছূ জিডিপি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, অথচ রাশিয়া, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাথাপিছু জিডিপি ২০১৪ সালের তুলনায় কমে গেছে। এই বাড়া–কমার বিষয়টি আমার কলামের আলোচনার বিষয় না হওয়ায় আমি তথ্যগুলো কোন মন্তব্য ছাড়াই উপস্থাপন করলাম।
২০১৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই ১১ বছর ব্রিক্স দেশগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের প্রয়াস নিয়েছে, এবং তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোও ক্রমশ তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উড্স শহরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৪৫ সাল থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্রমশ আধিপত্য বিস্তারকারী নব্য–সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন–নেতৃত্বাধীন উন্নত, শিল্পায়িত পুঁজিবাদী দেশগুলো যেভাবে উপনিবেশ–উত্তর উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং গ্যাট ও এর উত্তরসূরি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিও টি ও’র মাধ্যমে প্রচেষ্টা জোরদার করে চলেছে ব্রিকসের নেতৃত্বে গত এক দশক ধরে তৃতীয় বিশ্ব তার বিরুদ্ধে প্রায়ই সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে। প্রধানত এহেন প্রতিরোধের কারণেই ২০০২ সালে শুরু হওয়া ডব্লিও টি ও’র ‘দোহা উন্নয়ন রাউন্ডের’ আলোচনা গত ২৩ বছরেও সম্পন্ন করা যায়নি, কেননা ঐ আলোচনায় উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো নিজেদের পাতে ঝোল টেনে নেয়ার অবস্থান ছাড়তে এখনো রাজি হচ্ছে না। তারা এখনো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অন্যায্য চুক্তি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য জোর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, আর ব্রিকসের নেতৃত্বে তাকে প্রতিরোধ করে চলেছে তৃতীয় বিশ্ব। এই নব্য–সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘আধিপত্য–পরনির্ভরতা তাত্ত্বিক কাঠামোর’ অনুসারী অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বগুলো পুঁজিবাদী কেন্দ্রসমূহ কীভাবে তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তীয় দেশগুলো থেকে পুঁজি পাচারের নানা মেকানিজমকে ব্যবহার করে চলেছে তার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। এর ফলে আফ্রো–এশীয় ও লাতিন আমেরিকার জনগণের মধ্যে গত পাঁচ দশকে এই বিষয়টি সম্পর্কে গভীর সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বিংশ শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকের প্রতিবিপ্লবের জোয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দাবিদার রাষ্ট্রগুলোর পতন ঘটেছে তবুও প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে পুঁজি–পাচারকে ঠেকাতে হলে নব্য–সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আগ্রাসনকে যে রুখতেই হবে—এই চেতনাটুকু ক্রমেই সঞ্চারিত হচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্বের জনমানসে। তারই প্রতিফলন ঘটছে লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশে বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি কতৃ্র্ক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘটনাবলীতে। সমাজতান্ত্রিক কিউবায় তো ১৯৫৯ সাল থেকেই বামপন্থী সরকার টিকে রয়েছে মার্কিন অবরোধ সত্ত্বেও। অবশ্য, ব্রিকসে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে, কারণ ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব অব্যাহত রেখেছে। উপরন্তু, ভারত ও চীনের সম্পর্ক শত্রুতামূলক বলা চলে। অতএব, সুযোগ পেলেই ভারত ব্রিকসের অভ্যন্তরে ‘সাবোটিয়ার’ এর ভূমিকা পালন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অন্যদিকে, পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বর্তমান পর্বে বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শুরু থেকেই ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ ছদ্মবেশধারী বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সারা বিশ্বের একক মতাদর্শিক ব্যবস্থা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগ্রাসী তৎপরতাকে দিনদিন জোরদার করে চলেছে। বৃটেনের ‘থ্যাচারিজম’ এবং মার্কিন ‘রেগানোমিক্স’কে এই তৎপরতার দার্শনিক ভিত্তি বলে মনে করা হয়। এই প্রয়াসের অংশ হিসাবেই ১৯৭৯ সালে উইলিয়ামসন–কথিত ‘ওয়াশিংটন কনসেনসাস’ প্রণীত হয়েছিল মার্কিন ট্রেজারী ডিপার্টমেন্ট (মানে অর্থ মন্ত্রণালয়), আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যে। এই ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমেই এগিয়ে চলেছে আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংককে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’ সারা বিশ্বের দেশে দেশে প্রচলনের মূল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের সাম্রাজ্যবাদী খেলা। ১৯৭৯ সালেই বাংলাদেশ এই আগ্রাসনের জালে আটকা পড়েছিল। ঐ সময়টাতে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসে প্রতিবছর মারাত্মক ঘাটতি হতো। এদেশের রপ্তানি আয় দিয়ে ঐ বছরগুলোতে আমদানি ব্যয়ের ৩০–৩২ শতাংশের বেশি মেটানো যেতোনা, যার ফলে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা ছিল মারাত্মক। এক পর্যায়ে জিডিপি’র ১৩.৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল ঐ খয়রাত–নির্ভরতা। তাই বাধ্য হয়ে জিয়াউর রহমানের সরকারকে আইএমএফ এর দ্বারস্থ হতে হয়েছিল এঙটেন্ডেড ফান্ড ফেসিলিটি বা ইএফএফ থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য। ১৯৮০ সালে ঐ ঋণ অনুমোদন করা হলেও ঋণের সাথে বিরাট একটা শর্তের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। ঐ শর্তগুলো এতই কঠোর ছিল যে জিয়াউর রহমানের সরকার ওগুলো পূরণে ‘ধীরে চলো নীতি’ অবলম্বন করে। ফলে, শর্ত–পূরণের অপারগতার অজুহাতে ঋণের প্রথম কিস্তির ২০ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার পর আইএমএফ রুষ্ঠ হয়ে বাকী ৭৮০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ঐ শর্তগুলোর অনেকগুলো পূরণ করা হয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই শর্তগুলোকে ‘কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি’ বা স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ হিসাবে অভিহিত করে আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংক তাদের ঋণ পাওয়ার প্রায় অভিন্ন শর্তাবলীতে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশগুলো গত সাড়ে চার দশক ধরে এই দুটো সংস্থা থেকে যত ঋণ নিয়েছে তার সবগুলোতেই ঘুরেফিরে এই শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোও তাদের এই জবরদস্তি থেকে রেহাই পায়নি। প্রাইভেটাইজেশন, ডিরেগুলেশন, লিবারালাইজেশন এবং গ্লোবালাইজেশন —এই চারটি ডাইমেনশানে অর্থনীতির ওপর ব্যক্তিখাতের নিয়ন্ত্রণকে যথাসম্ভব নিরংকুশ করা এবং রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করার এই মতাদর্শিক জবরদস্তি তৃতীয় বিশ্বের সচেতন জনগণের মধ্যে ক্রমেই প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ, আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রীরা গত চার দশক ধরে প্রয়োজন না থাকলেও আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের তাবৎ অপমানজনক শর্তাধীন ঋণ পাওয়াকে তাঁদের বাহাদুরি হিসাবে জাহির করতেন। এখন তো জিডিপি’র এক শতাংশের কাছাকাছি পর্যায়ে নেমে গেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ–নির্ভরতা, এখনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই বদ–খাসলত ছাড়তে পারছে না কেন বুঝিনা! বর্তমানে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও আইএমএফ থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছে সরকার, তার শর্তের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে এখন হস্তক্ষেপ করছে আইএমএফ। সম্প্রতি ডলারের দামকে বাজারীকরণের জন্য আইএমএফ যেভাবে বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করেছে তা এই নগ্ন চাপ প্রয়োগের সর্বশেষ নজির। যথাসম্ভব শীঘ্র ব্রিক্স জোটে বাংলাদেশের যোগদান এহেন ব্ল্যাকমেইলিং থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়াবে। পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার সময় ব্রিক্্সে যোগ দেওয়ার জন্য সরকারের জোর লবিং–এর কথা শোনা গেলেও সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু, ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্রিক্সের সদস্য হওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহই দেখাচ্ছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখার জন্য। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়