২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারত–বিরোধিতা এবং ক্রমবর্ধমান পাকিস্তান–প্রীতির পথে অগ্রসর হচ্ছে—যা আমার কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। স্বৈরশাসক হাসিনা গণতন্ত্রকে বরবাদ করে দিয়ে আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকার খায়েসে তাঁর ভারত–প্রীতিকে অযৌক্তিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিন–তিনটি নির্বাচনকে যখন একতরফা প্রহসনে পরিণত করে তাঁর একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে ‘আজীবন শাসনে’ রূপান্তরিত করার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন তখন তাঁর এহেন নতজানু ভারত–খেদমতের কারণে ভারতের সরকারগুলো তাঁর ঐ খায়েসকে মেনে নিয়েছিল। পাঠকদের কি মনে আছে ২০১৪ সালে ভারতের পররাষ্ট্র–সচিব বাংলাদেশে এসে হাসিনার একতরফা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করেছিলেন? ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ বিরুদ্ধে ভারত একবারও টুঁ শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। ২০২৪ সালের ‘আমি–ডামি নির্বাচনের’ পর ভারত সরকার হাসিনাকে ভূমিধস বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিল। এর বিনিময়ে হাসিনা ভারতকে সাড়ে পনেরো বছর ধরে একের পর এক একতরফা কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা দিয়ে গেছেন, যার সর্বশেষ নজির ছিল তিস্তা মহাপ্রকল্পে চীনের পরিবর্তে ভারতকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করা এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের লাইন ব্যবহার করে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে ভারতীয় ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা করা। এভাবে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী ভারতের প্রশ্নহীন সমর্থন পেয়ে হাসিনা ভেবেছিলেন, তাঁর আজীবন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার খায়েস তিনি পূরণ করতে পারবেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ লক্ষ মানুষ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলে প্রমাণ করে দিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শাহাদতের মাধ্যমে যে দেশটি স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে সে দেশের জনগণ কাউকে স্বৈরশাসক হিসেবে দীর্ঘদিন মেনে নেবে না।
‘বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের’ যেসব নেতা সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের আধিক্য থাকার বিষয়টি জনগণের কাছে ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি। ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’ বলে নূতন রাজনৈতিক দল গড়ে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে তৎপর রয়েছে। তাদের কেউ কেউ এমনও বলা শুরু করেছে যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ‘দুই ভাইয়ের ঝগড়া’। তাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে নাকি ১৯৪৭ সালের চেতনা এবং ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করাই বেশি যুক্তিযুক্ত। জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ–সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির, ১৯৭১ সালে যার নাম ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ, তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্বাধীনতার বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত ছিল না, তারা সরাসরি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ‘অক্সিলারী ফোর্স’ হিসেবে আল–বদর ও আল–শামস বাহিনী গঠনের মাধ্যমে গণহত্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। জামায়াতে ইসলামী গত ৫৪ বছরেও তাদের ‘মানবতা–বিরোধী অপরাধের’ জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তাদের কাছে পাকিস্তানের ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন এখনো গ্রহণযোগ্য রয়ে গেছে। অথচ, সারা বিশ্ব এতদিনে জেনে গেছে কী চরম বঞ্চনা, শোষণ, লুন্ঠন, পুঁজি–পাচার ও বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। এখনকার ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডারদের জন্মই হয়নি ১৯৭১ সালে, কিন্তু ঐ নির্মম ইতিহাসের সাথে কি তাদের পরিচিত হতে হবে না? জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্ক–ধোলাইয়ের শিকার হয়ে জামায়াতের স্বাধীনতা–বিরোধী বয়ানকেই কি তারা আঁকড়ে থাকবে? তাদের জন্য নিচের তথ্য–উপাত্তগুলো উপস্থাপন করছি।
১৯৪৭–১৯৭১—এই চব্বিশ বছর ধরে পূর্ব বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুন্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজিপাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল সে সম্পর্কে গত ৫৪ বছরে সব তথ্য–উপাত্ত এখন বিশ্বের সামনে উদঘাটিত হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কোন বাঙালি কীভাবে আজো পাকি–প্রেমে বুঁদ হয়ে থাকে? কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত–বিরোধী হয় সেটাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় হবে না। কিন্তু, পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্যে জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল বা প্রধানমন্ত্রীর পদ কোন বাঙালিকে দেওয়া হয়নি। যদিও ঐ–পর্যায়ে পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে ছিল কিন্তু ২৪ বছরের অভ্যন্তরীণ–ঔপনিবেশিকপর্বের শেষে এসে পাঞ্জাব এবং করাচী অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের চাইতে অনেকখানি সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিচের তথ্য–উপাত্ত থেকে এই ঔপনিবেশিক শোষণ, লুন্ঠন, বঞ্চনা ও পুঁজিপাচারের চিত্রটা কিঞ্চিৎ পাওয়া যাবে:
১) প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫–৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানী আইটেমগুলো থেকে। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কোরিয়া যুদ্ধ এবং প্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে পূর্ব বাংলার পাট রপ্তানি আয়ে একটা জোয়ার সৃষ্টি হওয়ায় ঐ অনুপাত ৮০–৮৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ, ঐ রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭–৪৮ অর্থ–বছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭–১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক–পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
২) ইঙ্গ–মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ঐ বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ঐ ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ এবং অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।
৩) পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণ গ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার এবং শিল্পপতি–ব্যবসায়ীরা কব্জা করে নিয়েছে।
৪) ঐ ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারী বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।
৫) ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয়বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।
৬) পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানীদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি পাঁচ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
৭) ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্প–কারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকী ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্প–কারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।
৮) মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। এমনকি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সকল সোনাদানা এবং বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে।
৯) ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী এবং অবাঙালিরা।
১০) যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমান বাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএ’র বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।
১১) পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচী, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান।
১২) ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ এবং এর শাখানদীগুলোতে বাঁধ এবং ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যা সমাধানের জন্য ‘ক্রুগ কমিশনের’ রিপোর্ট বাস্তবায়নের কোন প্রয়াসই নেয়নি অর্থায়নের অভাবের কথা বলে। উক্ত সেচ ব্যবস্থার কারণে পাঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে, ঐ ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি শুষ্ক মৌসুমে সেচের আওতায় আনা হয়েছিল।
স্বাধীনতা–উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চাইতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, যা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যোৗক্তিক ছিল। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের তুলনাটা দেখুন:
১) মাথাপিছু জিডিপি’তে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে ৭০ শতাংশ পিছিয়ে ছিল, কিন্তু ২০২৫ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৬৫ শতাংশ এগিয়ে গেছে।
২) বাংলাদেশের রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চাইতে ২০ বিলিয়ন ডলার বেশি, ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে তা ছিল ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার।
৩) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৫ সালের মে মাসে আইএমএফ এর হিসাব–পদ্ধতি মোতাবেক ২২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যেটা পাকিস্তানের দ্বিগুণেরও বেশি।
৪) বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর।
৫) বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ।
৬) বাংলাদেশের মোট জিডিপি ৪৫০ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার।
৭) বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১২ শতাংশ, আর পাকিস্তানের ২.১ শতাংশ। ফলে, পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটিতে, আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটিরও কম।
৮) বাংলাদেশের ১২২ টাকায় এক ডলার পাওয়া যায়, পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ২৮০ রুপি লাগে। অথচ, ২০০৭ সাল পর্যন্ত রুপি’র বৈদেশিক মান টাকার তুলনায় আট শতাংশ বেশি ছিল।
৯) বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপি’র ২২ শতাংশ, অথচ পাকিস্তানে তা জিডিপি’র ৪৬ শতাংশ।
১০) বাংলাদেশের নারীদের ৪১ শতাংশ বাড়ীর আঙিনার বাইরে কর্মরত, পাকিস্তানে এই অনুপাত মাত্র ১৪ শতাংশ।
১১) বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১, আর পাকিস্তানে ৫৯।
১২) বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে, অথচ পাকিস্তানের ৭৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
উপরের তথ্য–উপাত্তগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়নের দৌঁড়ে আর কখনোই বাংলাদেশের নাগাল পাবে না ইনশাআল্লাহ। পাকিস্তানের জনগণ এখন বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খুবই আগ্রহী, কিন্তু ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি বাংলাদেশের কাছে এখনো ক্ষমা প্রার্থনায় রাজি নয়। সেজন্যেই বিএনপি–জামায়াতের নেতা–কর্মীদের কাছে আমার প্রশ্ন: বাংলাদেশ যেখানে একটি দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে গো–হারা হারিয়ে দৃপ্তপদে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে অযৌক্তিক পাকি–প্রেম কেন? পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় কিছুই নেই। জামায়াতের পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা–বিরোধী বিধায় অগ্রহণযোগ্য। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাসিনার সরকারের মত ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু ভারতের মত বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই হবে, নইলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়