২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটেগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এবং ঐ প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর আগে ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের ‘নিম্ন আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরি থেকে বাংলাদেশ ‘নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ’ ক্যাটেগরিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৮–১৯ অর্থ–বছরে ৮.১৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ২০২০–২২ পর্বে করোনা ভাইরাস মহামারি এবং রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি ছিল এবং ২০২২–২৩ অর্থ–বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার সাড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে হতাশাজনক অভিমত দ্রুত বদলাতে শুরু করেছিল। ২০১১ সালে বিশ্বখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অগ্রযাত্রার বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে এ–বিষয়ে বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ২০১২ সালে বৃটেন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী সাপ্তাহিক পত্রিকা দি ইকনমিস্ট নিশ্চিত করলো যে সত্যিসত্যিই বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের এমন এক স্তরে উপনীত হয়েছে যেখান থেকে অর্থনীতিবিদরা প্রকৃতপক্ষেই আশাবাদী হয়ে উঠছেন যে বাংলাদেশ ক্রমেই অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠছে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বৃটেনের আরেকটি খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা দি গার্ডিয়ান ভবিষ্যদ্বাণী করলো যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইউরোপের প্রধান প্রধান কয়েকটি অর্থনীতিকেও ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর অমর্ত্য সেন ২০১৩ সালের জানুয়ারীতে ঘোষণা দিলেন, ভারতের চাইতে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও মানব উন্নয়নের অনেকগুলো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্জন ভারতের চাইতে ভালো। এর কিছুদিন পর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সংস্থাগুলোর অন্যতম গোল্ডম্যান স্যাক্স ‘ব্রিকস’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিন আফ্রিকা) নামে অভিহিত বিশ্বের দ্রুত উত্থানশীল অর্থনৈতিক শক্তিসমূহের ঠিক পেছনে অবস্থানকারী ‘পরবর্তী এগার উত্থানশীল অর্থনীতির’ তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। ২০২০ সালে আইএমএফ ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চাইতে বেশি হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের চাইতে ৮০ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। অতএব, স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।
কিন্তু, মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন–মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অতএব, আয়বৈষম্য ক্রমে বাড়তে থাকার প্রবণতাকে দেশের আসন্ন মহাবিপদ সংকেত বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রবৃদ্ধির সুখবরের পাশাপাশি এই একটি মহাবিপদ এদেশের ১৯৭৫–পরবর্তী শাসকমহল তাদের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক দর্শন ও উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে ডেকে এনেছে। দুঃখজনকভাবে আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি সহগ অন্যতম। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এর কাছাকাছি পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন নীতি–নির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত হাউজহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে মোতাবেক বাংলাদেশের জিনি সহগ নির্ধারিত হয়েছে ০.৪৮৩, যা ১৯৭৩ সালে ছিল মাত্র ০.৩৬। আরেকটি পরিমাপকের গতি–প্রকৃতির মাধ্যমে ২০১০ ও ২০১৬ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির বিপক্ষে এবং ৫–১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে মাত্র ০.২৩ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে। সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ৩৮.১৬ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরো দুঃখজনক হলো, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১৬ সালে চলে গেছে মোট জিডিপি’র ২৭.৮৯ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র–ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট–২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে, বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ধনকুবেরের সংখ্যা ছিল ২৫৫ জন।। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি ডলারের (প্রায় ৩০০ কোটি টাকা) বেশি নীট–সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্ট্রা–হাই নেট–ওয়ার্থ’ (ইউ এইচ এন ডব্লিউ’) ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সরকার পালাক্রমে এদেশে গত ৩২ বছরের মধ্যে ৩০ বছর সরকারে আসীন থাকলেও দেশে আয়বৈষম্য নিরসনে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সংবিধানে সমাজতন্ত্র ফেরত এসেছে। কিন্তু, নামকাওয়াস্তে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এব্যাপারে নীরবতা পালনকেই নিরাপদ মনে করছে। এর দুটো কারণ আন্দাজ করা যায়: প্রথমত, আওয়ামী লীগ নব্বই দশকের শুরুতেই ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’ প্রতিষ্ঠাকে তাদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্র এখন আর রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় নয়।
সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছানোর জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারিকরণ হয়ে গেছে; ৪) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ্এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫) দেশের জায়গা–জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৬) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৭) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটিতে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ বা ৮০ লাখ মানুষ বস্তীবাসী; ৮) দেশে গাড়ী, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ী আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়ীঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে। আবার অন্যদিকে দরিদ্র জনগণের সন্তানদের জন্য মাদ্রাসা গড়ে তোলার হিড়িক চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার শুধু মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়েই মাতামাতি করছে। আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফসল যে সমাজের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ–মধ্যবিত্তদের দখলে চলে যায় সেটা জনগণের কাছ থেকে লুকোতে চাইছে তারা। প্রান্তিক অবস্থানের শ্রমজীবী জনগণ এহেন প্রবৃদ্ধি থেকে তেমন সুফল পায় না। সরকার যেহেতু ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র পথ অনুসরণ করে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’কে সোৎসাহে চালু রেখেছে তাতে আয়বৈষম্য নিরসনের কোন তাগিদ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে পরিদৃষ্ট না হওয়াই স্বাভাবিক। আয়বৈষম্যের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারের এই দুঃখজনক অমনোযোগ অগ্রহণযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দেশটি অচিরেই একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হবে তা আমরা কিছুতেই মেনে নেবো না।
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবেলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরায়েল এবং শ্রীলংকায় রাষ্ট্র নানারকম কার্যকর আয় পুনর্বন্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদেরকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য–নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। উপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার এবং/অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে। বৈষম্য–সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে কয়েকটি বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে সেগুলো হলো:
১) রাষ্ট্রগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল লেভেলের শিক্ষায় একক মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে।
২) রাষ্ট্রগুলোতে অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৩) রাষ্ট্রগুলোতে প্রবীণদের পেনশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
৪) রাষ্ট্রগুলোতে সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু রয়েছে।
৫) এসব দেশে নিম্নবিত্ত জনগণের জন্যে ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনামূল্যে খাদ্য–নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে।
৬) প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্যে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা উন্নত–উন্নয়নশীল নির্বিশেষে এসব দেশে চালু রয়েছে।
৭) এসব দেশে গণপরিবহন সুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী, এবং ব্যক্তিগত গাড়ী ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয় ।
৮) এসব দেশে রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা চালু করেছে।
৯) এসব দেশ ‘মেগা–সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম–শহরের বৈষম্য নিরসন ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।
১০) দেশগুলোতে ‘ন্যূনতম মজুরীর হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১১) নিম্নবিত্তদের আবাসনকে সব দেশেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
১২) এসব দেশে কৃষকরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পান তার জন্যে কার্যকর সরকারী নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে।
১৩) ব্যক্তিখাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে সেজন্যে এসব দেশে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়